এই মহিলা সহায়তা কেন্দ্র থেকে ব্যাগ চুরি হয়। নিজস্ব চিত্র।
প্ল্যাটফর্মে তখনও সাতটা কুড়ির মশাগ্রাম লোকালটা ঢোকেনি। যাব বেলানগর। রবিবার। তা-ও এক ফোঁটা ফাঁকা নেই হাওড়া স্টেশন। ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে একটা মহিলা পুলিশ সহায়তা কেন্দ্র রয়েছে। তার কাছে দাঁড়িয়েই মোবাইলটা ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। হঠাত্ই মহিলা কণ্ঠে আর্তনাদ!
তাকিয়ে দেখি, ওই সহায়তা কেন্দ্রের ভিতরে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছেন পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা। পাশে এক প্রতিবন্ধী ভদ্রলোক ভ্যাবাচ্যাকা মুখে দাঁড়িয়ে। পরে জেনেছি, ওই মহিলার স্বামী তিনি। ঘাড় থেকে মাথা এক্কেবারে সামনে ঝুঁকে রয়েছে। কান্নার আওয়াজ শুনেই এগিয়ে যাই। কাঁদতে কাঁদতে ভদ্রমহিলা জানালেন, তাঁর হাত-ব্যাগটি খোয়া গিয়েছে। বড় লাগেজগুলো পড়ে রয়েছে। অথচ হাত-ব্যাগটি নেই। ওতেই ছিল সমস্ত টাকা-পয়সা, মোবাইল, কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র। এমনকী, কিছু গয়নাগাটিও। কত টাকা ছিল জিজ্ঞেস করায় জানালেন, হাজার পাঁচেক!
আরও পড়ুন- ডিঙি চেপে ভোট দিল বুনিয়াদপুর
কী ভাবে উধাও হল ব্যাগ?
পত্রলেখা চট্টোপাধ্যায় নামে ওই ভদ্রহিলা জানালেন, তাঁদের বাড়ি বোলপুরে। দমদমে ছেলের কাছ থেকে ঘুরে গয়া এক্সপ্রেস ধরে বাড়ি যাবেন। ওলা থেকে নেমে ওই পুলিশ সহায়তা কেন্দ্রে তাঁকে দাঁড় করিয়ে গৌরীশঙ্করবাবু গিয়েছিলেন টিকিট কাটতে। প্ল্যাটফর্মের ভিতরে ঢুকে এই জায়গাটাকে নিরাপদ ভেবে মালপত্র রেখেছিলেন তাঁরা। এ ছাড়া বেশির ভাগ দিনই ছ’নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকেই ৭টা ৫০-এ গয়া এক্সপ্রেস ছাড়ে, সেটা জেনেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গৌরীশঙ্করবাবু টিকিট কেটে এসে দেখেন পুলিশহীন সহায়তা বুথের ভিতরে পত্রলেখাদেবী কান্নাকাটি জুড়েছেন। কারণ, অন্য মালপত্রগুলো থাকলেও তাঁর হাত-ব্যাগটি উধাও।
সব শুনে তাঁকে জানানো গেল, পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করার কথা। কিন্তু, গৌরীশঙ্করবাবু তেমন যেন ভরসা পেলেন না! বললেন, ‘‘কী হবে ও সব করে!’’ এ দিকে ওঁদের ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র ৪৫ মিনিট বাকি। আমার মশাগ্রাম লোকালও ঢুকবে ঢুকবে করছে। কিন্তু, অসহায় ওই মহিলার পাশে দাঁড়ানোর জেদটা চেপেই গিয়েছে। একটা সহায়তা বুথ থেকে চুরি হয়ে যাবে! আর বুথে পুলিশই বা কেন থাকবে না? আমার বার দুয়েকের অনুরোধে শেষে পত্রলেখাদেবী রাজি হলেন।
কিন্তু, একটা অভিযোগ জানাতে গিয়ে যে এত বিড়ম্বনা দেখা দেবে তা জানা ছিল না। গৌরীশঙ্করবাবুকে ফের ওই বুথের ভিতর দাঁড় করিয়ে পত্রলেখাদেবীকে নিয়ে প্রথমে গেলাম ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মুখের রেলে একটি সহায়তা কেন্দ্রে। সব শুনে ওখানকার কর্মীরা আমাদের পাঠিয়ে দিলেন পাশের আরপিএফ বুথে। সেখানে গিয়েও কোনও অভিযোগ জানানো গেল না। কর্তব্যরত এক আরপিএফ কর্মী জানান, “এখানে কোনও ডায়েরি করা যায় না। আপনাদের জিআরপি অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে।” কোথায় সেই অফিস? পৌঁছে দেওয়া তো দূরস্থান, দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সাহায্য চাইলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হল, “এখুনি বড়বাবু আসবেন। এখান থেকে কাউকে পাঠানো যাবে না।”
আরও পড়ুন- জোড়া অভিযানে ঘরে ফিরল বহু শিশু
একটু কথা কাটাকাটির পরিস্থিতি তৈরি হতেই শেষে সাংবাদিক পরিচয়টা দিতে বাধ্য হলাম। তখন এক মহিলা কর্মীকে আমাদের সঙ্গে পাঠাতে রাজি হলেন ওই আরপিএফ কর্মী। গয়া এক্সপ্রেস ছাড়তে তখনও ৩০ মিনিট বাকি! আমার মশাগ্রাম লোকাল হয়তো ছেড়েই দিয়েছে।
রবিবার হাওড়া স্টেশনে সেই অসহায় দম্পতি পত্রলেখাদেবী এবং গৌরীশঙ্কর চট্টোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
হাওড়া স্টেশন থেকে বেরিয়ে একশো মিটারের মধ্যেই জিআরপি ফাঁড়ি। সেখানে অভিযোগ জানাতে গিয়ে পত্রলেখাদেবী ফের কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এক হোমরাচোমরা পুলিশ কর্মী রীতিমতো উঁচু গলায় তাঁকে ধমক দিয়ে বললেন, “এখানে কান্নাকাটি করে চিত্কার করছেন কেন? যা বলার শান্ত ভাবে বলুন।” এর পর এক ঝাঁক প্রশ্নবাণ! ‘মহিলা পুলিশ সহায়তা কেন্দ্রে আপনি কী করতে বসেছিলেন?’, ‘জানেন না ওখানে বসার নিয়ম নেই?’— ইত্যাদি।
পাল্টা প্রশ্ন করতে বাধ্য হলাম। ‘‘ওনারা সহয়তা কেন্দ্রে থেকে অন্যায় করেছেন। কিন্তু, ওখানে কেন কোনও কর্মী ছিলেন না?’’ প্রশ্নটা করেই বুঝলাম, বিষয়টা ভদ্রলোকের পছন্দ হয়নি। তাই অনুরোধ করলাম, ‘‘তাড়াতাড়ি, যদি ডায়েরিটা নিয়ে নেন... আসলে ওঁদের ট্রেনটাও তো ধরতে হবে!’’ এ বার কড়া ধমক ফুটে উঠল ভদ্রলোকের ভাষায়, ‘‘আপনি কে? এখানে কেন এসেছেন? বাইরে বেরিয়ে যান। আপনি না বেরনো পর্যন্ত কোনও কথা শুনব না।’’ ফের সাংবাদিক পরিচয় দিতে হল। আর আচমকাই পরিবেশটা পাল্টে গেল। যে গলা এত ক্ষণ ধমকাচ্ছিল, সেই কণ্ঠস্বরই কেমন খাদে নেমে গেল। সহযোগিতার একাধিক হাত এগিয়ে এল। এমনকী, ‘দুর্ব্যহারের জন্য’ ক্ষমাও চেয়ে নিলেন ওই জিআরপি কর্মী।
আরও পড়ুন- বাহিনীর হাতে পাহাড়ি শিশুর জন্য চকলেট
এর পর রীতিমতো ‘যুদ্ধকালীন তত্পরতা’য় দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। গৌরীশঙ্করবাবুকে ওই বুথ থেকে গয়া এক্সপ্রেসের প্রতিবন্ধী কামরায় তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। ডায়েরি করে তার প্রতিলিপি হাতে দিয়ে আমাদেরও জিআরপি কর্মীরা পৌঁছে দেন ছ’নম্বর প্ল্যাটফর্মে। ট্রেনে তুলে দিয়ে গৌরীশঙ্করবাবুর কাছ থেকে বাকি তথ্য নিয়ে ডায়েরির বাকি কাজ শেষ করেন তাঁরা। ট্রেন ছাড়া অবধি অপেক্ষা করেন ওই কর্মীরা।
গৌরীশঙ্করবাবুদের ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার পর আমি ফের বর্ধমান লোকালের অপেক্ষায়। এই ট্রেনটাও বেলানগর যাবে। দেখলাম, ওই মহিলা পুলিশ সহায়তা কেন্দ্রে মোতায়েন হয়েছেন এক পুলিশ কর্মী। তবে, ১০ মিনিটও পেরল না। ফের নিরাপত্তা কর্মীহীন ওই সহায়তা কেন্দ্র।
সোমবার সকালে যোগাযোগ করেছিলাম, পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রবি মহাপাত্রের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘‘এমনটা হয়ে থাকলে, ঠিক হয়নি। অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেন ওখানে কোনও নিরাপত্তা কর্মী ছিলেন না, কেনই বা ওই যাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হল, সবটাই খতিয়ে দেখা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy