Advertisement
E-Paper

বুকে বিঁধে ত্রিশূল, রক্ত ঝরছে

ফোন ধরতে ইন্ডিয়ার দিকে নামতে হয়। তেষ্টার জলের খোঁজে ভরসা সেই ভুটান। চা-বাগানের শেষ প্রান্তে কারি লাইনের চড়াই ভেঙে ঘর হতে ঠিক দুই পা ফেললেই হবে। সবুজ মাঠে হলুদ ফুলের থোকা। এটা নাকি বিদেশ! চার কুড়ি পার করা শরীরটা টেনে লাঠি ধরে ওঠেন বড়া অসুর।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:০০

ফোন ধরতে ইন্ডিয়ার দিকে নামতে হয়। তেষ্টার জলের খোঁজে ভরসা সেই ভুটান।

চা-বাগানের শেষ প্রান্তে কারি লাইনের চড়াই ভেঙে ঘর হতে ঠিক দুই পা ফেললেই হবে। সবুজ মাঠে হলুদ ফুলের থোকা। এটা নাকি বিদেশ! চার কুড়ি পার করা শরীরটা টেনে লাঠি ধরে ওঠেন বড়া অসুর।

শুধু ঘরের গরু-ছাগল চরাতে নয়! ম্যাটাডরে সুপুরি লোডিং বা ধান খেতের ঠিকা কাজেও নিত্য হাতছানি দেয় ভুটান। কিংবা চা-বাগিচার মাইনে জুটলে ১০০ টাকা গচ্চা দিয়ে কড়া তরল ‘রক্সি’র নেশাতেও লা-জবাব ভুটানের নৈনিতাল।

কিন্তু এই আশ্বিনে বিষাদ মেঘে মোড়া নীল পাহাড়ের দিকে আপনা থেকেই এগিয়ে যায় পা দু’টো। পিছে পড়ে এ দেশের শেষ জনপদ— নাগরাকাটার ক্যারন চা-বাগানের কারি লাইন, ফ্যাক্টরি লাইন, ম্যানেজারের কুঠি! কিংবা দুর্গামণ্ডপ!

দুর্গাকে ঠিক কেমন দেখতে তা অবশ্য বলতে পারবেন না বৃদ্ধ। আদিম জনজাতি অসুরদের মহল্লা, কারি লাইনের গাঁওবুড়ো তিনি। সাতজন্মে মণ্ডপমুখো হননি। তবে মেয়ে কুঁয়ারির টি এস্টেটের মজুরি থেকে পুজোর চাঁদা কেটে নেওয়া হয়। দু’দফায় ১০০ করে ২০০ টাকা! রাগটা চুপচাপ গিলে ফেলেন বড়া অসুর। ‘‘চাঁদা দিতে হয়েছে! কিন্তু পুজো আমরা কখনও করিনি! ভাল লাগত না।’’ এ উৎসব থেকে বরাবর ছিটকে থেকেছেন বৃদ্ধ। মণ্ডপের ঢাকের শব্দ, ভোগের খিচুড়ির গন্ধে গায়ে ছ্যাঁকা লাগে। কেউ যদি ফের অষ্টমী-নবমীতে মণ্ডপে যাত্রাগান শুনতে ডাকে! তাই দুপুর থেকে ঘর ছেড়ে ভুটানেই ঢুকে বসে থাকেন।

কেন?

সে মহাভারত ঘাঁটাঘাঁটিতেও আর রুচি নেই বুড়োর। কয়েক মাস আগে খাস দিল্লিতে অবধি এ নিয়ে ধুন্ধুমার হয়ে গিয়েছে। মহিষাসুরের মৃত্যুতে ‘শহিদ দিবস’ পালন নিয়ে বিতর্ক। তাতে নাকি দুর্গার অপমান! গোঁসা হয়েছিল এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর। সে সব কিস্‌সা ভিন গ্রহের গল্প মনে হয়।

ক্ষয়াটে গড়ন, কুতি কুতি চোখ! নিরীহ বড়া অসুরকে দেখে পৌরাণিক অসুরদের একজন বলে কল্পনা করা কঠিন! তিন বছর আগেও আদিবাসীদের প্রকৃতি পূজা সরনার থানে, শালগাছের কোলে পাহান বা পুরুতগিরি করতেন এই অসুর কুলপতি। এখন গির্জায় যান। অধুনা ক্যারনে অসুরকুলের লট কে লট খ্রিস্টান হয়েছেন। সরনা পূজার ভদ্রস্থ চাঁদাই ওঠে না। নান্নু অসুর, বান্ধে অসুররা বলেন, অসুর শুনতে কেমন খারাপ লাগে! তাই অনেকেই পদবী পাল্টে টোপ্পো বা কুজুর…

মহিষরাজের বংশধর শুনে হাসাহাসিও করে অনেকে! বড়া অসুর গম্ভীর হন। মহিষাসুরের নাম না-করে বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে বলেন, ‘‘দুর্গার পূজা কখনও করিনি। তখন নিজের ঘরে বা আখাড়ায় আমাদের মাতা-পিতা-পূর্বজের পূজা করতাম।’’ কারি লাইনের প্রাক্তন ম্যানেজার সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, বছর পাঁচেক আগেও পুজোর দিনে অসুরদের ঘরে নিজেদের গড়া মাটির মহিষাসুর দেখেছেন। কুমোরটুলির অসুরের মতো গাঁট্টাগোট্টা নয়। ছোট্টখাট্টো পুতুল গোছের আদল। আর সবার মতোই পুজোয় হাঁড়িয়া খেয়ে বুঁদ হয়ে থাকত অসুররা। তবে মস্তিতে নয়, শোকে!

ঠিক যেমন ঝাড়খণ্ডে! সেখানেও লাতেহারের শাখুয়াপানির সুষমা অসুর, ঝোবিপাটের মিলন অসুররা সপাটে বলেন, এটা শোকের সময়! অসুরদের পূর্বপুরুষ বলে কথিত দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহিষরাজকে ছল করে ফাঁদে ফেলে খতম করেছিল দুর্গা। ক্যারনের ফেন্সিংম্যান প্রদীপ অসুর কিছু দিন আগে ঝাড়খণ্ডে পূর্বপুরুষদের ভূমি গুমলার বিষুণপুর দেখে এসেছেন। আফশোস করেন, দাদাজির বাবা অসুর কেন যে মরতে এসেছিল এ তল্লাটে! ও দিকে বক্সাইট খাদানে কাজ করে তাও ভাল আছে জাতভাইরা! আর প্রদীপ তিন ছেলেমেয়েকে জামাকাপড় দিতেই হিমশিম। তবে স্ত্রীকে লুকসান বাজার থেকে সেকেন্ডহ্যান্ড কালার টিভি কিনে দিয়েছেন।

চা-বাগিচার খালাসি সন্তোষ অসুর ক্যারনে টিনের চাল, মাটির ঘরের বাসিন্দা। জল আনতে ভুটানের ঝোরায় যেতে হয়। মোবাইলের সিগন্যাল নড়বড়ে। গোটা ডুয়ার্স জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারে কয়েক হাজার অসুরের দশাই তথৈবচ। বাগিচার শ্রমিক বা ভুটান পাড়ি দেওয়া মজুরদের দিন গুজরান মেরেকেটে আড়াই-তিন হাজার টাকা মাস মাইনেয়। চা-বাগিচা যখন পুজোয় মাতে, তখন এই অসুররা কি অশৌচ পালন করেন? পুজো দেখে ফেললে পাছে পূর্বপুরুষের অপমান হয়, মায়েরা নাকি ছাড়তে চান না সন্তানকে? ক্যারনের ম্যানেজার প্রিয়ব্রত ভদ্র শুনে হাসেন, সে সব আগেকার কথা। ‘‘এই তো কারি লাইনের সন্তোষ অসুর, খাপরা লাইনের সুঠা অসুর পুজো কমিটিতে রয়েছে। নাচ হবে। সবাই ভোগ খাবে। রাতভর মণ্ডপের মাঠে হিন্দি বই দেখতে গোটা বাগানের মজুর-কুলিকামিনই ঝেঁটিয়ে আসবে।’’

অসুরকন্যা সাধনি, মাংরি, পুত্রী, দ্বারিকারা কারি লাইনের না-অসুর বুজুর্গ জগন্নাথ সিংয়ের ঘরে নাচের মহড়া দিতে আসছেন! নাগাড়া নিয়ে তৈরি চৌকিদার রতুয়া অসুর। পুরনো খাতা দেখে প্রায় মুছে যাওয়া ভাষার সুর গুনগুন করেন জগন্নাথ। ‘করঞ্জ বাহা লাকন রাঈজ...!’ করঞ্জী ফুলের সাজে সেজে, অ্যাই মেয়ে চল নাচি জোড়ে...। শুনে নিঃশব্দে উঠে যান বড়া অসুর। ‘‘দিওয়ালির সময়ে সোহরাই পরবে নাকে-বুকে-নাভিতে করঞ্জী ফুলের তেল মাখা হতো।’’

কিংবদন্তী বলে, দুর্গার ত্রিশূলে এই তিন অঙ্গে রক্ত ঝরেছিল মহিষাসুরের। উৎসবের সুরে সেই পুরনো ক্ষত রক্তাক্ত হয় অনিবার।

Durga puja Bhutan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy