Advertisement
E-Paper

অকাল ম্যালেরিয়ার মৃত্যু-হানায় উদ্বেগ রাজ্যে

বৃষ্টি হবে। এখানে-সেখানে বৃষ্টির পরিষ্কার জল জমবে। সেই জমা জলে ডিম পাড়বে অ্যানোফিলিস মশা। আর সেই মশা যত বাড়বে, ততই ছড়াবে ম্যালেরিয়া। এটাই দস্তুর। তাই সাধারণত ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ হয়ে থাকে বর্ষা শেষের পরেই।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ মে ২০১৬ ০৩:৫৩

বৃষ্টি হবে। এখানে-সেখানে বৃষ্টির পরিষ্কার জল জমবে। সেই জমা জলে ডিম পাড়বে অ্যানোফিলিস মশা। আর সেই মশা যত বাড়বে, ততই ছড়াবে ম্যালেরিয়া। এটাই দস্তুর। তাই সাধারণত ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ হয়ে থাকে বর্ষা শেষের পরেই।

এখন মাটি খটখটে। পুকুর-ডোবা-নালা-জলা ফুটিফাটা। এমন দহনক্লিষ্ট পরিবেশে তো জীবাণু-ভাইরাসকুলের দফারফা হয়ে যাওয়ার কথা। তার বদলে দক্ষিণবঙ্গের নানা জেলায় থাবা বসাচ্ছে ম্যালেরিয়া। এই অকাল ম্যালেরিয়ায় শুধু এপ্রিলেই দক্ষিণবঙ্গে মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের! যা গত বছরে এই সময়ে ম্যালেরিয়া-মৃত্যুর চার গুণ।

গাঙ্গেয় বঙ্গে ঘোরতর গ্রীষ্মে ম্যালেরিয়ার এমন তীব্র সংক্রমণে পরজীবী বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকেরা হতবাক। এক ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, এখন ম্যালেরিয়ায় কমবেশি সংক্রমণ হয় সারা বছর ধরেই। কিন্তু এপ্রিলে ম্যালেরিয়ায় এত প্রাণহানি মোটেই স্বাভাবিক নয়।

রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের রিপোর্ট বলছে, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁদের রক্তে মিলেছে প্লাসমোডিয়াম ফ্যালসিপেরামের জীবাণু। অর্থাৎ মৃতদের সকলেই আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায়। অসময়ে ম্যালেরিয়া সংক্রমণের থেকেও স্বাস্থ্য দফতরের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই রোগে এক মাসে ১৭ জনের প্রাণহানি। রক্তপরীক্ষায় ম্যালরিয়ার জীবাণু সহজেই শনাক্ত করা যায়। সাধারণ ম্যালেরিয়া এবং ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে। রোগ নির্ণয় ঠিক সময়ে হলে এবং ঠিকঠাক ওষুধ পড়লে এখন ম্যালেরিয়ায় মৃত্যু হওয়ারই কথা নয়। তাই দক্ষিণবঙ্গে ম্যালেরিয়ায় এক মাসে এত মৃত্যু কেন, সেটা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ভবন।

এপ্রিলে ম্যালেরিয়ার বাড়বাড়ন্তকে কী ভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞেরা?

‘‘আসলে আজকাল সব মরসুমেই দেদার ফ্যালসিপেরাম পাওয়া যাচ্ছে। আমার ব়ড়বাজারের ল্যাবরেটরিতে এপ্রিলেই ছ’জন ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ার রোগী পেয়েছি। মনে হচ্ছে, ম্যালেরিয়ার পরজীবীটি আর প্রচলিত ওষুধে মরছে না। তাই রোগটা ঘুরেফিরে আসছে,’’ বললেন পতঙ্গবিদ এবং স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিয়কুমার হাটি।

অকাল ম্যালেরিয়ার পিছনে পুরনো রোগীদের ‘অবদান’-ও দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। ম্যালেরিয়া বিশেষজ্ঞ এবং ট্রপিক্যালের প্রাক্তন অধিকর্তা অমিতাভ নন্দী জানান, যাঁরা অক্টোবর-নভেম্বরে ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন, তাঁদের অনেকে পুরোপুরি সেরে ওঠেন না। কারণ, প্রচলিত ওষুধে ম্যালেরিয়ার জীবাণু কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে মাত্র। তাদের মৃত্যু হয় না। ‘‘ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সক্রিয় থেকে যাচ্ছে ফ্যালসিপেরাম জীবাণু। এপ্রিলে যখন মশা একটু একটু করে বাড়ছে, তখন ওই সব রোগীর দেহ থেকে জীবাণু নিয়ে মশারা অন্যদের মধ্যেও ওষুধ-প্রতিরোধী ফ্যালসিপেরাম ম্যালেরিয়া ছড়াচ্ছে,’’ মত অমিতাভবাবুর।

এপিডেমিওলজিস্ট বিজয় মুখোপাধ্যায় মনে করেন, এপ্রিলে মশা থাকতেই পারে। ফলে ম্যালেরিয়া অস্বাভাবিক নয়। ‘‘কিন্তু তাতে এত লোকের মারা যাওয়াটা অস্বাভাবিক। ধরে নেওয়া যায়, রোগ সময়মতো নির্ণয় হচ্ছে না,’’ বলছেন বিজয়বাবু।

ম্যালেরিয়া চিহ্নিত করা এবং সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করার মধ্যে ব্যবধান যে রয়েই গিয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানাচ্ছেন, বহু রোগী যেমন সরকারি হাসপাতালে দেরি করে এসেছেন, একই ভাবে অনেক হাসপাতাল আবার সময়মতো রোগ ধরতে পারেনি। ‘‘ম্যালেরিয়া চিকিৎসার যে-প্রথা (স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট প্রোটোকল) রয়েছে, অনেক মেডিক্যাল কলেজ স্তরের হাসপাতালে তা মানা হয়নি। এটা কাম্য নয়। আমরা তদন্ত করছি,’’ আশ্বাস দিয়েছেন শতপথী।

অথচ সচেতনতা ও সতর্কতা থাকলে রোগের মোকাবিলা অসম্ভব নয় বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে হাতের নাগালেই। কিন্তু সেই পদ্ধতিতে সব ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া যে সারছে না, সেটা কত জন জানেন— প্রশ্ন তুলেছেন অমিতাভবাবু। তিনি জানান, প্রতিরোধী ম্যালেরিয়া সহজে ধরা পড়ে না। কারণ, এই ধরনের রোগীর শরীরে ম্যালেরিয়ার স্বাভাবিক উপসর্গ থাকে না। যদি বা ধরা পড়ে, প্রচলিত ওষুধ কাজ হয় না। সব চিকিৎসকের পক্ষে বিষয়টি ধরাও সম্ভব নয়। ‘‘তাই বিষয়টি বুঝতে বুঝতেই রোগীর অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিকল্প ওষুধ দেওয়ার সুযোগই পাওয়া যাচ্ছে না। মৃত্যুও বাড়ছে,’’ প্রাণহানির কারণ ব্যাখ্যা করলেন অমিতাভবাবু।

বর্ধমান, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত এক মাসে গড়ে ৪-৫ জন ম্যালেরিয়া রোগীর মৃত্যু হয়েছে। তাদের চিকিৎসা কেমন হয়েছে? বর্ধমান মেডিক্যালের একটি রিপোর্ট দেখিয়ে এক স্বাস্থ্য কর্তা বলেন, খণ্ডঘোষের এক কিশোরী জ্বর ও অচেতন অবস্থা নিয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয় ২০ এপ্রিল। তা সত্ত্বেও কিশোরীর টাইফয়েড-জন্ডিস থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা করা হলেও ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা করার কথা মনে হয়নি চিকিৎসকদের। যখন রক্ত পরীক্ষা করে ম্যালেরিয়া প্রমাণিত হয় তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ম্যালেরিয়ার উপসর্গেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেই এসেছেন পেট ব্যথা, বমি, ডায়েরিয়ার মতো উপসর্গ নিয়ে। তাঁদের মধ্যে কেঁপে জ্বর আসা, অসহ্য মাথা যন্ত্রণা — এ সব ছিল না। ফলে প্রথম দিকে অনেকেই বুঝতে পারেননি ম্যালেরিয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তা বলেন, যে সব এলাকা ম্যালেরিয়াপ্রবণ বলে পরিচিত এ বার সেখানে রোগ ছডায়নি। ছড়িয়েছে যে সব এলাকা ম্যালেরিয়াপ্রবণ নয়, সেখানে। যেমন, ম্যালেরিয়া প্রবণ ঝাড়গ্রাম-বিনপুর-বাঘমুণ্ডির বদলে এ বার বেশি রোগ হয়েছে শালবনি-গড়বেতায়। বাঁকুড়ার রানিবাঁধের থেকে বেশি রোগী মিলেছে বিষ্ণুপুর সদরে, যা অপ্রত্যাশিত।

স্বাস্থ্য সচিব রাজেন্দ্র শুক্ল মুখ খুলতে চাননি। স্বাস্থ্য দফতরের যুগ্ম স্বাস্থ্য অধিকর্তা (জনস্বাস্থ্য) কমলকৃষ্ণ পতির কথায়, ‘‘বৃষ্টি শুরুর পর আসল ম্যালেরিয়ার মরসুম এলে কী হবে ভেবে আমরা চিন্তিত।’’

Malaria death
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy