লাদাখের কোলে সেই স্কুলটা নিশ্চয়ই মনে আছে! ‘থ্রি ইডিয়েটস’ ছবিতে কচিকাঁচাদের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের টোটকা কাজে লাগিয়েই মুশকিল আসান হচ্ছে রোজকার জীবনে। বিজ্ঞানের অন্দরের মজাকে চেটেপুটে নিচ্ছে পড়ুয়ারা, খেলার ছলে। তবে এ বার রুপোলি পর্দার ‘র্যাঞ্চো’ আমির খানের সেই স্কুল শুধু লাদাখ নয়, পৌঁছে যাবে দেশের প্রায় সমস্ত রাজ্যেই। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা এমনই।
পড়ুয়াদের কাছে বিজ্ঞান, অঙ্ক, প্রযুক্তিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের স্কুল শিক্ষা এবং সাক্ষরতা বিভাগ দেশের মোট ৫০০টি স্কুলকে বেছে নিয়ে সেখানে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য উন্নতমানের গবেষণাগার তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অটল ইনোভেশন মিশন।’ এ জন্য এই স্কুলগুলির প্রত্যেকটিকে ১০ লক্ষ টাকার অনুদান দেওয়া হবে। কোন রাজ্য থেকে কোন স্কুল অনুদান পাবে সেই নাম পাঠাতে হবে রাজ্য সরকারগুলিকে।
এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কী?
কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের এক কর্তা জানান, পড়ুয়াদের মনে প্রযুক্তি বিষয়ক যে কল্পনা, যে কোনও বস্তুকে ভেঙে ফের গড়ে তোলার মধ্যে যে কৌতূহল, সেটাকেই শিক্ষার কাজে লাগাতে চায় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। অগ্রাধিকার দিতে চায় পড়ুয়াদের সৃষ্টিশীলতা এবং হাতে কলমে কাজ শেখার আগ্রহকে। সাধারণত দেখা যায়, অঙ্ক, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকেন্দ্রিক নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে পড়ুয়াদের মধ্যে একটা অজানা ভীতি কাজ করে। শিক্ষাবিদদের মতে, এই ভীতির অন্যতম কারণ হল, বইয়ে পাঠ্য বিষয়গুলি নিয়ে হাতেনাতে পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ পায় না পড়ুয়ারা। ফলে বিষয়টি সম্পর্কে তাদের মনে একটা ধোঁয়াশা থেকে যায়। তা থেকেই সেই বিষয়ের প্রতি অনীহা এবং ভয় জন্মায়। স্কুল থেকেই পড়ুয়াদের কাছে বিজ্ঞানের পরীক্ষানিরীক্ষার মজাটা তুলে ধরতে ভয় ভাঙতে চায় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। তাই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে উন্নতমানের গবেষণাগার তৈরির ভাবনা।
স্কুলে গবেষণাগার গড়তে চেয়ে নাম পাঠিয়েছে এই রাজ্যের ৩৩৬টি স্কুল। সারা দেশে সংখ্যাটা ১৩ হাজারের মতো। প্রাথমিক ভাবে তাদের মধ্যে থেকে ৫০০টি স্কুলকে বেছে নেওয়া হবে। তবে শুধু স্কুলের নাম পাঠালেই হবে না। গবেষণাগারের সুযোগ পাওয়ার জন্য বেশ কিছু শর্ত চাপিয়েছে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। যেমন, গবেষণাগার তৈরির জন্য স্কুলকে দিতে হবে ১৫০০ বর্গফুট এলাকা। পাহাড়ি এবং উপকূলবর্তী এলাকার ক্ষেত্রে জায়গার আয়তন ১০০০ বর্গফুট। আবেদনকারী স্কুলগুলিতে থাকতে হবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিষেবা।
এই শর্তাবলি নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। এই রাজ্যে শিক্ষাজগতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এই ধরনের প্রস্তাবকে সমর্থন করলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এত জায়গা সমস্ত স্কুলের পক্ষে দেওয়া কার্যত সম্ভব নয়। তা ছাড়া যে রাজ্যের স্কুলগুলি দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগের অভাবে ধুঁকছে, সেখানে এই গবেষণাগারে সহায়কদের কতখানি পাওয়া যাবে, তাই নিয়েই রয়েছে সংশয়। সে ক্ষেত্রে বড় এবং উন্নত পরিকাঠামোর স্কুলগুলি ছাড়া কেন্দ্রের এই প্রসাদ জুটবে না কারওই।
টাকি বয়ে়জ স্কুলের প্রধান শিক্ষক পরেশকুমার নন্দ বলেন, ইচ্ছে থাকলেও পরিকাঠামোর অভাবে তিনি আবেদন করতে পারেননি। ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পটি অবশ্যই প্রশংসনীয়, তবে সেই পরিকাঠামো, জায়গা না থাকায় আমার পড়ুয়ারা প্রকল্পের মজাটা পাবে না’’, বলেন তিনি। পরিকাঠামো থাকলেও শুঁড়াকন্যা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সময়ের অভাবে আবেদন করতে পারেননি। ‘‘২০১২ সালেও কেন্দ্র সরকারের এমন একটি প্রকল্প এসেছিল। তাতে আমাদের স্কুল নির্বাচিত হলেও প্রশিক্ষণের একটি জটিলতায় প্রকল্পটি বাস্তব রূপ পায়নি। তবে পড়ুয়াদের স্বার্থেই এই জাতীয় প্রকল্প আরও বেশি করে নেওয়া প্রয়োজন,’’ বলেন প্রধান শিক্ষিকা দেবযানী দত্ত রায়। আবেদন করেছেন যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্য। তবে শহরে সম্ভবপর হলেও গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলি আদৌ আবেদন করার যোগ্যতায় পৌঁছতে পারবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত তিনিও। ‘‘শুধু গবেষণাগার তৈরি করলেই হবে না। শিক্ষকদের তেমন প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে তাঁরা পড়ুয়াদের মনে সেই কৌতূহলটা জাগাতে পারেন,’’ বলেন পরিমলবাবু।
পরিকাঠামো বা প্রশিক্ষণ ছা়ড়াও অন্য একটি দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নারকেলডাঙা স্কুলের শিক্ষক স্বপন মন্ডল। তাঁর কথায়, ‘‘সারা দেশে মাত্র ৫০০টা স্কুলে এই প্রকল্পের চিন্তা যুক্তিযুক্ত নয়। প্রতি জেলায় অন্তত একটা করে স্কুলও এতে উপকৃত হবে না বলে মনে হয়।’’ রাজ্যের শিক্ষকদের অধিকাংশের মতে, কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনাটি ভালে। কিন্তু তার বাস্তবতা নিয়ে আরও আলোচনা করে তার পরে কার্যকর করার দিকে এগোলে লাভ হতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy