পার্থ বিশ্বাস ও বর্ণালি বিশ্বাস
কেটে গিয়েছে ছ’টা বছর।
এত দিন দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করার পরে ভেঙে গিয়েছে বর্ণালি বিশ্বাসের ধৈর্য্যের বাঁধ। নৈহাটির বাড়িতে আগলে রেখেছিলেন অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়িকে। প্রতি মুহূর্তে লড়াই চালিয়েছেন অনটনের সঙ্গে। মনকে শক্ত করে, শাখা-পলা-সিঁদুর পরে আসানসোল-নৈহাটি যাতায়াত করেছেন। আর এই ছ’টা বছর ধরে বাঁকুড়া হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে পড়ে থেকেছে তাঁর স্বামী পার্থ বিশ্বাসের দেহ।
পার্থ। রাজ্য পুলিশের ইন্সপেক্টর, ২০১০ সালে অক্টোবরে বন্ধু সৌম্যজিত বসুকে সঙ্গে নিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। সে দিনই, ২২ অক্টোবর জানা যায়, মাওবাদীদের হাতে অপহৃত হয়েছেন দুই বন্ধু। তার পর থেকে আর খোঁজ-খবর মেলেনি তাঁদের। কানা-ঘুষো শোনা গিয়েছিল, মাওবাদীরা মেরে ফেলেছে দুই বন্ধুকেই। পরের বছর, ২০১১ সালের ১১ মার্চ অযোধ্যা পাহাড় থেকেই মাটি খুঁড়ে দু’টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়। দু’জনের চেহারা দেখে চেনার উপায় ছিল না অবশ্য। কিন্তু পার্থর বাবা-মা এবং সৌম্যজিতের মায়ের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষার পরে পুলিশ জানায়, দেহ দু’টি পার্থ ও সৌম্যজিতেরই। ব্যান্ডেলের সৌম্যজিতের দেহ ২০১১ সালের ১৮ মে সৎকার করে তাঁর পরিবার।। কিন্তু পার্থর মৃত্যু মানতে চাননি বর্ণালি। ‘‘আমি বিশ্বাস করি না পার্থ মারা গিয়েছে,’’ তখন জোর গলায় বলেছিলেন তিনি।
সেই বিশ্বাস বুকে নিয়েই ছ’টা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। এখন আর পারছেন না। গত কয়েক বছর ধরে শ্বশুর-শাশুড়ির চিকিৎসার পিছনে জলের মতো টাকা খরচ হয়েছে। দু’জনের বয়সই সত্তরের কোঠায়। এই সবের সঙ্গে বর্ণালিকে একটানা লড়াই চালাতে হয়েছে নিজের মনের সঙ্গেও। কিন্তু ‘পার্থ ফিরে আসবে’—এই বিশ্বাসটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হতে শুরু করেছে। বাস্তবটা মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন শুভাকাঙ্ক্ষীরাও। এত দিন পরে, সেই ‘বিশ্বাস’ থেকে সরে পার্থর মৃত্যুটা মেনে নিয়েছেন তিনি। বর্ণালি এখন স্বামীর ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ হাতে পেতে চান। এবং স্বামী সরকারি কর্মী হিসেবে তাঁর যা যা প্রাপ্য, সেটুকুও।
এ মাসেই রাজ্য পুলিশকে চিঠি দিয়ে বর্ণালি জানিয়েছেন, তিনি মেনে নিচ্ছেন পার্থ মারা গিয়েছেন। বাঁকুড়ার সম্মিলনী হাসপাতালের মর্গে যে দেহটি রয়েছে, সেটি তাঁর স্বামীরই। পাঁচ বছর আগের সেই ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলটাও মেনে নিচ্ছেন তিনি। তবে বর্ণালির ঘনিষ্ঠ মহল জানাচ্ছে, পার্থর দেহটা তিনি হাতে পেতে চান না। তাঁর বন্ধুরাই সেই দেহ সৎকার করবে বলে জানা গিয়েছে।
বাঁকুড়া হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, কাপড়ে মোড়া পার্থর সেই দেহ এখনও হিমায়িত অবস্থায় রাখা আছে। আর দশটা সাধারণ মৃতদেহ শনাক্ত না হয়ে এ ভাবে পড়ে থাকলে তা সরকারের পক্ষ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সৎকার করে দেওয়া হয়। স্পর্শকাতর এই ঘটনার ক্ষেত্রে ঝুঁকি নেয়নি সরকার। তাই ছ’বছর ধরে পার্থর দেহ পড়ে রয়েছে হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে।
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা শুক্রবার জানান, বর্ণালির চিঠি পাওয়ার পরে তাঁরা বাঁকুড়া হাসপাতালে যোগাযোগ করে জেনেছেন, ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য জেলাশাসক চূড়ান্ত অনুমতি দেবেন। সম্প্রতি বাঁকুড়ার জেলাশাসককে চিঠি লিখে সেই অনুরোধ করা হয়েছে।
যাঁকে ঘিরে এত টানাপড়েন, সেই বর্ণালির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ফোনের ও-প্রান্ত থেকে একটি ক্লান্ত-অবসন্ন কণ্ঠ শুধু বলল, ‘‘আমাকে ছেড়ে দিন। এ নিয়ে কথা বলতে আর ইচ্ছা করছে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy