আখতার খান।
সরু গলির ভিতরে তস্য গলি। জায়গায় জায়গায় জটলা। স্থানীয় মানুষের আলোচনায় একটা নাম বারবার উঠে আসছে।
আখতার খান! চুপচাপ থাকা সেই ছেলেটা!
আইএসআই চর সন্দেহে শনিবার রাতে কলুটোলায় ধরা পড়া আখতার নাকি এখানেই থাকত। মধ্য কলকাতার এই ঘিঞ্জি কলিন স্ট্রিটে। অন্তত আধার কার্ডের তথ্য তা-ই বলছে। রবিবার সেখানে গিয়ে আখতার খানের বাড়ির হদিস শুধোতে এক জন সঙ্গে সঙ্গে আঙুল তুলে বাতলেও দিলেন!
পুরনো দোতলা বাড়ি। উঠোন থেকে লম্বা খাড়া সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। দোতলায় উঠে দু’দিকে দু’টো ঘর। বাঁ দিকের ঘরের ভিতর থেকে এক মহিলাকণ্ঠ স্পষ্ট জানিয়ে দিল, আখতার খানের ব্যাপারে কিছু খবর দিতে পারবেন না।
আখতার কি এখানে থাকত না? পুলিশ যে বলছে, এটাই ওর ঠিকানা!
প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণের নীরবতা। ফের ভেসে এল একই মহিলা কণ্ঠ— ‘‘হ্যাঁ, আগে এখানেই থাকত। আমার দেওর। ওর সম্পর্কে কিছু জানি না।’’
ইতিমধ্যে ডান দিকের ঘর থেকে এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এসেছেন। নিজেই পরিচয় দিলেন। মইনুদ্দিন। সম্পর্কে আখতারের মামা। জানালেন, সপ্তাহখানেক ধরে আখতার নিরুদ্দেশ ছিল। পুলিশ ডায়েরি করা হয়েছিল। শনিবার রাতে পুলিশ ওর এক দিদি সুরাইয়াকে জানায়, আখতারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ও কি কখনও পাকিস্তানে ছিল?
মইনুদ্দিন জানান, ছিল। তাঁর ভাগ্নে বেশ কয়েক বছরই পাকিস্তানে কাটিয়েছে। ‘‘কিন্তু পাকিস্তানে যাওয়া মানেই কি জঙ্গি হয়ে যাওয়া?’’— পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন বৃদ্ধ। অভিযোগ করেন, পুলিশ আখতারকে স্রেফ ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
গোয়েন্দাদের একাংশের অবশ্য দাবি, আখতার আদতে পাকিস্তানি নাগরিক। কলকাতায় মামার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। অন্য দিকে মইনুদ্দিনের পরিবারের বক্তব্য, আখতার ও তার চার ভাই-বোন কলকাতায় বড় হয়েছে। ওদের আধার কার্ড, পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড রয়েছে। আখতারদের জন্ম তা হলে কোথায়?
এর স্পষ্ট উত্তর কিন্তু মেলেনি। মামা শুধু বলেন, ‘‘কলিন স্ট্রিটের একটা ছোট স্কুলে আখতার কিছু দিন পড়াশোনা করে। তার পরে ক’বছরের জন্য বিদেশে চলে যায়। ২০১১-য় ফিরে আসে।’’ মইনুদ্দিন জানান, আখতারের এক দিদি সুরাইয়ার বাড়ি তপসিয়ায়। দেশে ফেরা ইস্তক ও সেখানে বেশি থাকত। কাজ করত নানা হোটেলে, বার টেন্ডার হিসেবে। মকটেল-ককটেল তৈরিতে আখতারের নাকি বেশ নামযশ!
দিদি কী বলেন? টেলিফোনে সুরাইয়াকে ধরা হলে তিনি জানান, ৬ তারিখ দুপুরে তপসিয়ার বাড়ি থেকে আখতার বেরিয়েছিল। বলেছিল, হাওড়ার এক পার্টিতে বার টেন্ডারের কাজ করতে যাচ্ছে। তার পরে খোঁজ নেই! মোবাইলও বন্ধ! ৭ নভেম্বর তিলজলা থানায় মিসিং ডায়েরি করা হয়। ১০ নভেম্বর লালবাজারে গোয়েন্দা-বিভাগে গিয়ে দেখাও করেন সুরাইয়ারা। শেষমেশ শনিবার, অর্থাৎ ১৪ তারিখ রাতে পুলিশ ওঁদের জানিয়েছিল, আখতারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ‘‘আগের এক সপ্তাহ ও তা হলে কোথায় ছিল? পুলিশ পরিষ্কার করে জানাক।’’— বলছেন পরিজনেরা।
নিরীহ, শান্ত স্বভাবের ছেলেটার বিরুদ্ধে আইএসআই-সংশ্রব ও চরবৃত্তির মতো গুরুতর অভিযোগ কী ভাবে উঠল, কলিন স্ট্রিটের পড়শিরাও তা ভেবে পাচ্ছেন না। এ দিন ওঁদের মুখে জানা গেল, আখতার পাড়ায় কোনও দিন কোনও গোলমালে জড়ায়নি। এক পড়শির কথায়, ‘‘আখতার ভাইকে ছোটবেলা থেকে চিনি। বরাবর শান্ত। বছর চারেক আগে বিদেশ থেকে ফিরে যেন আরও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। কারও সঙ্গে মেলামেশা করত না।’’
আখতার খানের এ হেন ‘একাচোরা’ স্বভাব দেখেও গোয়েন্দাদের মনে সন্দেহের ভিত ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। তাঁরা বলছেন, নজর এড়ানোর থাকার তাগিদে চরেরা হামেশাই এমন একান্ত বৃত্তে নিজেকে গুটিয়ে রাখে।
‘‘যেমন রেখেছিল আখতার খান।’’— মন্তব্য এক গোয়েন্দা অফিসারের।