মানুষের হাসপাতালে কুকুরের ডায়ালিসিস করানোর আবদার ধরেছিলেন তিনি। সেই মতো তোড়জোড় করেও শেষ মুহূর্তে উদ্যোগটি ভেস্তে যায়। তবে ঘটনাটিকে ঘিরে ওঠা শোরগোলের রেশ এখনও কাটেনি। তারই মধ্যে নতুন আবদার করে তিনি এসে গেলেন নতুন বিতর্কের শিরোনামে!
তিনি, মানে তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজি। অভিযোগ: নির্মলবাবু এ বার চেয়েছিলেন, তাঁর ডাক্তারি-পড়ুয়া ছেলের পরীক্ষার সময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রের সিসিটিভি-ক্যামেরা যেন বন্ধ করা থাকে। এবং ছেলে যেন নিজের মর্জিমাফিক জায়গায় বসে উত্তর লিখতে পারে!
নির্মলবাবুর ছেলের সিট পড়েছিল যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে, তার কর্তৃপক্ষের দাবি: খাস স্বাস্থ্যভবনের শীর্ষ মহল থেকেও এই মর্মে তাঁদের কাছে ‘অনুরোধ’ এসেছিল। তাঁরা আবদার পত্রপাঠ নাকচ করেন, যার জেরে দু’পক্ষে কিঞ্চিৎ কথা কাটাকাটিও হয়। রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষার চেহারাটা ঠিক কী রকম, দিন দশেক আগের এই ঘটনাটিকে তার প্রকৃষ্ট নমুনা হিসেবে দেখছেন স্বাস্থ্য দফতরের একাধিক কর্তা। প্রসঙ্গত, নির্মলবাবু একাধারে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল ও চিকিৎসক সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও বটে।
ঠিক কী হয়েছিল?
সূত্রের খবর: নির্মলবাবুর ছেলে কেপিসি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএসের ছাত্র। তার ফার্স্ট এমবিবিএস প্রফেশনাল পরীক্ষার সিট পড়েছিল জোকা ইএসআই মেডিক্যাল কলেজে, যেটি আদতে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ। অভিযোগ: নির্মলবাবু ফোন করে সেখানকার অধ্যক্ষ জয়শ্রী মিত্রঘোষকে বলেন, পরীক্ষা চলাকালীন হলের সিসিটিভি-ক্যামেরা যেন বন্ধ রাখা হয়। ছেলের জন্য নির্দিষ্ট সিট নম্বর না-রাখার আর্জিও করেন। ‘‘উনি বলেন,
ছেলে যাঁর পাশে বসে পরীক্ষা দিতে চাইবে, তেমনই যেন বন্দোবস্ত হয়।’’— মন্তব্য সূত্রটির।
রাজ্যের স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এই মুহূর্তে অন্যতম ‘প্রভাবশালী’ ব্যক্তিটির এ হেন ‘অনুরোধ’ জয়শ্রীদেবী অবশ্য রাখতে পারেননি। সটান জানিয়ে দেন, কোনওটাই করা সম্ভব নয়। জোকা মেডিক্যালের এক কর্তার বক্তব্য: তাঁদের পরীক্ষার হলে এত দিন সিসিটিভি ছিল না। টোকাটুকি রুখতে সপ্তাহ দুয়েক আগে বসানো হয়েছে। সেটি বন্ধ রাখার প্রশ্নই আসে না। আর মর্জিমাফিক বসার বন্দোবস্ত চিন্তার অতীত। কর্তাটি বলেন, ‘‘শিক্ষাক্ষেত্রে বহু ধরনের নৈরাজ্য চলছে। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় জেনে-শুনে এ ভাবে চোখ-কান বুজে থাকলে বিবেক দংশনে ভুগব। তাই আমরা নির্মলবাবুর কোনও কথাই মানিনি। কেন মানিনি, সেটাও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি।’’
এবং ওঁদের আরও অভিযোগ, নির্মলবাবুর ছেলের জন্য ‘বিশেষ’ ব্যবস্থা করতে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকেও অনুরোধ এসেছিল, যা কি না আরও বিস্ময়ের। সূত্রের খবর, জয়শ্রীদেবী ওঁর কাছে জানতে চান, রাজ্যের মেডিক্যাল-শিক্ষার শীর্ষ পদে থেকে এমন অনুরোধ কী ভাবে করা হচ্ছে? থিওরি পরীক্ষায় যত্রতত্র বসার আবদারই বা কোন যুক্তিতে?
‘‘দু’তরফে সামান্য কথা কাটাকাটিও হয়।’’— বলেন জোকার এক কর্তা। যাঁর আক্ষেপ, ‘‘বহু অনভিপ্রেত জিনিস দেখছি। এ যা হল, চরম দুর্ভাগ্যজনক। নজিরবিহীন।’’ ‘অনুরোধ’ আসার কথা স্বীকার করে নিলেও জয়শ্রীদেবী বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি। তাঁর শুধু মন্তব্য, ‘‘আমি দেখেছি, পরীক্ষা যেন নিয়ম মেনে হয়। কোনও অন্যায় আবদার মানিনি, মানবও না।’’
নির্মলবাবু কী বলছেন?
বুধবার তাঁকে ফোনে ধরা হলে তিনি পুরো বিষয়টি শোনেন। তার পরে ফোন কেটে দেন। রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবতোষ বিশ্বাসও তা-ই। আর সুশান্তবাবুর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘বিষয়টি আমি মানছি না।’’ জানা গিয়েছে, ঘটনাটি গোড়ায় গোপনই ছিল। পরে জোকা মেডিক্যালের কয়েক জন শিক্ষক-চিকিৎসক তা প্রকাশ্যে আনেন। স্বাস্থ্যভবনকেও অবহিত করা হয়।
সরকারি তরফে এখনও হেলদোল দেখা না-দিলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের প্রাক্তন বিশেষ সচিব তথা এমবিবিএস ও ডেন্টালের কেন্দ্রীয় সিলেকশন কমিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান শ্যামলকুমার বসু বলেন, ‘‘এমবিবিএস ফার্স্ট প্রফেশনাল ডাক্তারি পড়ুয়াদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে পরীক্ষা না-হলে ঠিকঠাক ডাক্তার তৈরি হবে কী ভাবে?’’ কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের মন্তব্য, ‘‘নির্মল মাজি তো যে কোনও মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপ্যালের চেয়ার টেনে বসে পড়েন! ডাক্তারদের বদলির হুমকি দেন। উনি এমন বেয়াড়া আবদার করবেন, তাতে আশ্চর্য কী?’’
চিকিৎসক মহলের একাংশের অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয়ের হাত মাথায় থাকার সুবাদেই নির্মলবাবু বারবার নানা অনৈতিক কাজ করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। বস্তুত কুকুর-কাণ্ডের জেরে নির্মলবাবুর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তা জানতে খোদ রাজ্যপালের অফিস থেকে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি এসেছিল। তার পরেও দফতর নড়েচড়ে বসেনি। রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবেও ওঁর বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার বিস্তর অভিযোগ। এমনকী, রাজ্যগুলির মেডিক্যাল কাউন্সিলের ‘অকর্মণ্যতা’র নিরিখে পশ্চিমবঙ্গকে সেরা শিরোপা দিয়েছে এমসিআই!
অভিযোগই সার। নির্মলবাবুর গায়ে আঁচড়টি লাগেনি। রাজ্যের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কথায়, ‘‘কুকুর-কাণ্ডের পরে নির্মল মাজির রেজিস্ট্রেশন বাতিল হওয়ার কথা। নতুন অভিযোগ প্রমাণিত হলে আরও কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। আমার আমল হলে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তাকেও সাসপেন্ড করতাম।’’ তৃণমূল জমানায় যে যা খুশি করে পার পেয়ে যাচ্ছে বলে আক্ষেপ করেছেন সূর্যবাবু। কিন্তু জোকা মেডিক্যাল কলেজ এত সাহস দেখাতে পারলেও রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা কেন গুটিয়ে?
স্বাস্থ্য ভবনের এক আধিকারিকের ব্যাখ্যা, ‘‘ওটা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে। তাই সাহস দেখাতে পারছে। আমাদের হাত-পা বাঁধা। যে সাহস দেখাবে, পর দিন তার পদ থাকবে না। কিংবা সুন্দরবনে বদলি হয়ে যাবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy