মাঝরাতে ফোন পেয়ে চমকে উঠেছিলেন প্রবীণ ডাক্তারবাবু। হ্যালো বলতেই ও-পার থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর— আপনি বেঁচে আছেন!
থতমত খেয়ে কোনও মতে ‘হ্যাঁ’-টুকু বলতে পেরেছেন ডাক্তারবাবু। ‘বেঁচে আছেন কি না’ জানতে চেয়ে টেলিফোনে ক’দিন ধরেই জেরবার উত্তরপাড়া-কোতরং এলাকার বিশিষ্ট এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও তাঁর পরিবার। ফোনে এমনকী শোকবার্তাও আসছে! শুক্রবার দেখলাম একটি খবরের চ্যানেলও আমার মৃত্যু সংবাদ শোনাচ্ছে— বলছেন ওই প্রবীণ চিকিৎসক।
এই পরিস্থিতির নেপথ্যে রয়েছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ঘুরে বেড়ানো একটি বার্তা। যাতে বলা হয়েছে, ‘ওই চিকিৎসকের বাড়িতে হানা দিয়ে আয়কর দফতর ১০ কোটি টাকা ও গয়না বাজেয়াপ্ত করেছে। তার পরেই আত্মহত্যা করেছেন ডাক্তারবাবু।’ লাগাতার মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে শনিবার উত্তরপাড়া থানার দ্বারস্থ হয়েছেন ওই প্রবীণ চিকিৎসক। কয়েক জনের নাম দিয়ে অভিযোগও দায়ের করেছেন তিনি।
ওই চিকিৎসকের আয়কর সংক্রান্ত আইনজীবী সোমেন দত্ত বলেন, ‘‘আমার মক্কেলের নামে আয়কর দফতরে কোনও অভিযোগ নেই। তাঁর বাড়িতে কোনও তল্লাশিও হয়নি। ফলে টাকা-গয়না বাজেয়াপ্ত করার প্রশ্নই নেই। ওঁকে হেনস্থা করার জন্যই এ সব প্রচার করা হচ্ছে।’’
নভেম্বরের ৮ তারিখ রাতে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালাচ্ছে আয়কর দফতর। সেই খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই হোয়্যাটসঅ্যাপ, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ছে নানা বার্তা। কখনও বা কোনও নামী বিরিয়ানির দোকানের নাম নিয়ে, কখনও আবার শিকার হচ্ছেন ডাক্তারবাবুর মতো প্রবীণ নাগরিকেরা।
পুলিশের একাংশ জানাচ্ছেন— সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, হোয়্যাটসঅ্যাপ-র ব্যবহার যেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, তেমনই সেখানে বাড়ছে কুৎসার বহরও। কখনও ব্যক্তিগত ক্ষোভ মেটাতে, কখনও বা নিছক মজা করতেই নানা রটনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকে। অনেকে আবার সে সব শেয়ারও করছেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে এ রাজ্যে সাইবার অপরাধ বেড়েছে ১২.১%। ব্যক্তিগত ঝাল মেটাতে সাইবার দুনিয়াকে ব্যবহার করার ঘটনায় দেশে চতুর্থ স্থানে পশ্চিমবঙ্গ।
সাইবার অপরাধ দমনে পারদর্শী পুলিশ অফিসারেরা জানান, কখনও লোকের নাম, ছবি দিয়ে নানা কথা লিখে দেওয়া হচ্ছে, কখনও আবার কোনও তরুণী বা কিশোরীর নামে কুৎসা ছড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফেসবুক, হোয়্যাটসঅ্যাপকে। সাইবার বিশেষজ্ঞেরা জানান, নেট দুনিয়ায় হেনস্থার শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও বিরল নয়। ফেসবুকে এমন কুৎসা সহ্য করতে না-পেরে বছর দুয়েক আগে আত্মঘাতী হয়েছিলেন কলকাতার এক স্কুলছাত্রী। অন্য রাজ্যেও এমন বহু উদাহরণ রয়েছে।
ডাক্তারবাবু অবশ্য এতটা ভেঙে পড়েননি, তবে রটনার জল কত দূর গড়ায় তা টের পেয়েছেন তিনি। বলছেন, ‘‘গোড়ায় তেমন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু পরে দেখলাম, আর সহ্য করা উচিত হবে না।’’
সাইবার আইনজীবীরা বলছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে রসিকতা চলতেই পারে। কিন্তু মাত্রাজ্ঞান রেখে। এ ক্ষেত্রে যে ধরনের মিথ্যে খবর এই চিকিৎসককে নিয়ে করা হয়েছে, তাতে মানহানির মামলা হতে পারে।
সাইবার-আইনজীবী রাজর্ষি রায়চৌধুরীর মতে, ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে আগে ৬৬(এ) বলে একটি ধারা ছিল। এই ধরনের হেনস্থার ঘটনায় সেটা আদর্শ আইন হত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সেই আইন বাতিল করেছে। ফলে এ ক্ষেত্রে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী মামলা দায়ের করতে হবে। তাতে সর্বোচ্চ দু’বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।
রাজর্ষিবাবু বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতেরও দ্বারস্থ হতে পারেন ডাক্তারবাবু। অভিযুক্তদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও দাবি করতে পারেন তিনি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy