ফের শুরু হচ্ছে যমুনা মণ্ডলের বাড়ির নির্মাণকাজ। (ইনসেটে) তালা ভেঙে দোকান খুললেন শান্তিচন্দ্র রায়। বুধবার। — নিজস্ব চিত্র
বুধবার দোকান খুলেছেন শান্তিচন্দ্র রায়। সাত মাস পরে।
মঙ্গলবার রাতে বিডি ব্লকে নিজের জমিতে ইট ফেলেছেন যমুনা মণ্ডল। চার মাস পরে।
সন্তোষকুমার লোধের বিডি ৩৪৭ নম্বর বাড়িতেও শুরু হতে চলেছে সংস্কারের কাজ।
বিধাননগরের তৃণমূল কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় তোলাবাজির অভিযোগে শ্রীঘরে যাওয়ার পরে আচমকাই বদলে গিয়েছে ছবি। অনিন্দ্যের ‘কল্যাণে’ যাঁদের কাজকর্ম আটকে গিয়েছিল, তাঁরাই এখন বুক বাজিয়ে সামনে আসছেন। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে টাকার অঙ্ক উল্লেখ করতেও দ্বিধা করছেন না, যা কোনও না কোনও সময়ে অনিন্দ্য তাঁদের কাছ থেকে চেয়েছিলেন।
বিধাননগরের এবি-এসি মার্কেটে দু’টি দোকান ছিল শান্তিবাবুর। তার মধ্যে একতলার ফাস্ট ফুডের দোকানটি বিক্রি করে মার্কেটের দোতলায় আর একটি দোকান কেনেন। অভিযোগ, সেই দোকানে আসবাব তৈরির সময়েই অনিন্দ্যের প্রতিনিধিরা হানা দেন। শান্তিবাবুর অভিযোগ, ‘‘আমার কাছ থেকে ২ লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন অনিন্দ্য। বলেছিলেন, ‘আগের দোকান বিক্রির সময়ে টাকা নিইনি। কিন্তু, এ বার নতুন দোকান কেনার জন্য দিতে হবে।’ আমি রাজি হইনি। একে তো ধার করে সাড়ে ন’লক্ষ টাকায় দোকান কিনেছি। তার পরে আরও ২ লক্ষ টাকা! পারব না।’’
শান্তিবাবু জানানন, দোকান বন্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দিয়ে চলে যান অনিন্দ্যের লোকেরা। সেটা ডিসেম্বর। তখন থেকেই বন্ধ শান্তিবাবুর দোকান। বুধবার মার্কেটের সামনে এক জটলার মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘কাউন্সিলর যখন দেখলেন আমি টাকা দেব না, তখন টাকার অঙ্ক কমিয়ে দেড় লক্ষ করা হল। পরে আরও কমে যায় অঙ্ক। মাত্র দিন দশেক আগে কাউন্সিলরের প্রতিনিধিরা এসে জানান, উনি দেখা করতে চেয়েছেন। কানাঘুষোয় শুনলাম, ১০-১২ হাজার টাকা পেলেও আমার দোকান খুলে দেবে। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম যে, একটি টাকাও দেব না।’’
মঙ্গলবারই অনিন্দ্য গ্রেফতার হওয়ার খবর পেয়েছেন। বুধবার মার্কেটে এসে নিজেই টান মেরে সেই তালা ভেঙে খুলেছেন দোকান। শান্তিবাবু জানিয়েছেন, দু’এক দিনের মধ্যেই আসবাব তৈরির অসম্পূর্ণ কাজও শুরু করবেন।
১৯৭২ সালে বিডি ব্লকে জমি পেয়েছিলেন জয়নগরের পুলিনবিহারী মণ্ডল। বিডি ৩৮৬ নম্বরে সেই জমিটি খালিই পড়ে ছিল দীর্ঘদিন। মাঝে ২০০৫ সালে মারা যান পুলিনবাবু। সম্প্রতি তাঁর স্ত্রী, ৭০ বছরের যমুনাদেবী ওই জমিতে বাড়ি করতে উদ্যোগী হন। নিঃসন্তান বৃদ্ধা গত মার্চ মাসে ওই ২ কাঠা জমিতে নির্মাণের কাজ শুরু করেন। উদ্দেশ্য, একতলা একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি।
অভিযোগ, সেখানেও উদয় হন অনিন্দ্য। যমুনাদেবীর ডাক পড়ে তাঁর ওয়ার্ড অফিসে। বুধবার ওই বৃদ্ধার আত্মীয় গৌতম চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সে দিন যমুনাদেবীকে ডেকে সরাসরি ২০ লক্ষ টাকা চান অনিন্দ্য। তাঁর দাবি ছিল, এত দিন জমি খালি পড়ে ছিল। তিনিই নজর রেখেছিলেন বলে তা বেদখল হয়ে যায়নি। তাই তাঁকে ওই টাকা দিতে হবে। টাকার অঙ্ক শুনে ঘাবড়ে যাই। বলি, ‘আরে, বাড়ি তৈরি করতে তো এত টাকা লাগবে না!’ জানিয়ে দিই, টাকা দেওয়া সম্ভব নয়।’’
তত দিনে ওই জমিতে কিছুটা নির্মাণ হয়ে গিয়েছিল। তৈরি হয়েছিল তিন ফুট উঁচু পাঁচিলও। অভিযোগ, টাকা না পেয়ে প্রথমে সেই পাঁচিল ভেঙে দেন অনিন্দ্যের লোকজন। বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েও লাভ হয়নি। যতটুকু নির্মাণ হয়েছিল, তা সেই অবস্থায় ফেলে রাখতে বাধ্য হন যমুনাদেবী। অভিযোগ, দিন দশেক আগে অনিন্দ্যের দলবল এসে সেই নির্মাণ গুঁড়িয়ে দেয়। সেই জমিতেই মঙ্গলবার রাতে আবার ইট পড়েছে। গৌতমবাবু জানান, খুব তাড়াতাড়ি সেখানে নির্মাণের কাজ শুরু হবে।
অনিন্দ্যর গ্রেফতারের পরে গত দু’দিনে বিভিন্ন দিক থেকে প্রায় বন্যার মতো অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। সবটাই ওই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে টাকা তোলার অভিযোগ। বুধবার রাজ্যের এক প্রাক্তন তৃণমূল মন্ত্রী জানান, সল্টলেকে তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে জলের সংযোগ দেওয়ার বিনিময়ে অনিন্দ্য পাঁচ লক্ষ টাকা চেয়েছিলেন। বছর চারেক আগের ঘটনাটি সেই সময়েই দলকে জানান তিনি। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ওই বাসিন্দাকে শেষে ৪ লক্ষ টাকা দিতেই হয়েছে।
বিধাননগর ঘুরে বুধবার অনিন্দ্যর ঘনিষ্ঠ ও বিরোধী দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে যে নির্যাসটুকু উঠে এসেছে, তা হল— কাউন্সিলর হওয়ার আগে থেকেই তাঁর ‘টাকা তোলা’-র হাতেখড়ি। সাংবাদিক থাকাকালীনই বিধাননগরের বেআইনি জমি-বাড়ি হস্তান্তরের চক্রে ঢুকে পড়ে টাকা তোলার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। ২০১০ সালে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পরে সেই দাপট স্বভাবতই বেড়ে যায়। প্রথম পাঁচ বছরে তাঁর অধীনে থাকা তিনটি ব্লকে বেআইনি হস্তান্তর, বাড়ির সংস্কার, রাস্তার কাজ, মার্কেটের দোকান কেনা-বেচা, জলের সংযোগ, এমনকী বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের ঝামেলার মধ্যে ঢুকেও টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০১৫ সালে বিধাননগর ও রাজারহাট মিলে বিধাননগর পুর-নিগম তৈরি হয়। সে বার অনিন্দ্য নির্বাচনের টিকিট পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিল। সূত্রের খবর, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপত্তি জানিয়েছিলেন। অভিযোগ, বহু টাকা খরচ করে দলের বেশ কিছু নেতাকে ‘ম্যানেজ’ করে টিকিট জোগাড় করেন অনিন্দ্য। পুর-নিগমের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হওয়ার পরে অনিন্দ্যর অধীনে চলে আসে সাতটি ব্লক। যে দাপট এত দিন তিনটি ব্লক জুড়ে ছিল, এ বার তা ছড়িয়ে পড়ে সাতটি ব্লকে। অভিযোগ, ২০১৫ সালের পরে তাঁর টাকা তোলার পরিধি ছড়ায় ঝুপড়ি দোকান, ছাতুওয়ালা এমনকী রিকশাওয়ালাদের মধ্যেও। অভিযোগ, এর পরেই বেলাগাম টাকা তুলতে শুরু করেন অনিন্দ্য।
যাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হলেন বহু বিতর্কিত এই কাউন্সিলর, বহু চেষ্টার পরে ৭৮ বছরের সেই সন্তোষ লোধের সামনে পৌঁছনো গিয়েছিল এ দিন। অসুস্থ, ঘরবন্দি তিনি। অনিন্দ্যের প্রসঙ্গে শুধু দু’চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না। তাঁর মেয়ে সুতপা মিত্র বলেন, ‘‘ওই টাকা চাওয়ার পর থেকেই তো অসুস্থ। এমনিতেই কম কথা বলার মানুষ। ওই ঘটনার পরে আরও চুপ করে গিয়েছেন।’’
সন্তোষবাবু একটু সুস্থ বোধ করলেই বিডি ব্লকের ওই বিতর্কিত বাড়ির সংস্কারের কাজ শুরু হবে। তাঁদের পারিবারিক সূত্রেও এমনটাই জানা গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy