Advertisement
E-Paper

৫২টা মৃত্যু দেখেছে খয়রামারি

পাক্কা সাড়ে তিন বছর পরে কুটুম এসেছিল আমিনা বিবির বাড়িতে। দেড় দিনে, তাঁদের আতিথেয়তায় কসুর করেননিন তিনি— মাচার লাউ, খেতের শেষ শীতের ফুলকপি, দিশি মুরগির ঝোল, কিন্তু গাঁয়ের এক আঁজলা জল মুখে তোলাতে পারেননি তাঁদের। অভয় দেওয়ায় শুনতে হয়েছিল— না দিদি, আর্সেনিক ‘ছুপা’ থাকলে কী হবে?

সুজাউদ্দিন

শেষ আপডেট: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০২:১২
রিয়াজউদ্দিন মণ্ডল। আর্সেনিক দূষণের শিকার।

রিয়াজউদ্দিন মণ্ডল। আর্সেনিক দূষণের শিকার।

পাক্কা সাড়ে তিন বছর পরে কুটুম এসেছিল আমিনা বিবির বাড়িতে। দেড় দিনে, তাঁদের আতিথেয়তায় কসুর করেননিন তিনি— মাচার লাউ, খেতের শেষ শীতের ফুলকপি, দিশি মুরগির ঝোল, কিন্তু গাঁয়ের এক আঁজলা জল মুখে তোলাতে পারেননি তাঁদের। অভয় দেওয়ায় শুনতে হয়েছিল— না দিদি, আর্সেনিক ‘ছুপা’ থাকলে কী হবে?

আর্সেনিকের ভয়ে জলঙ্গির খয়রামারি পঞ্চায়েতের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলিতে কুটুম আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাত্র-পাত্রীর বাজারেও হুহু করে দাম পড়ছে হরেকৃষ্ণপুর, দক্ষিণ খয়রামারি, পাজরাপাড়ার। কেন? উত্তর মিলছে— ‘‘কে জানে বাবা, ওই সব গ্রামের ছেলে-মেয়েদের শরীরে কী রোগ বাসা বেঁধে আছে, ও গাঁয়ে বিয়ে নয়!’’

হবে নাই বা কেন, গ্রামের আনাচ কানাচ ঘুরলেই চোখে পড়ছে— আর্সেনিকের থাবায় কেউ হারিয়েছেন হাতের বুড়ো আঙুল, কেউ বা কনুই থেকে আস্ত ডান হাত। কারও বা হাঁটু থেকে পা-খানাই বাদ দিতে হয়েছে।

গ্রামের প্রান্তে সরকার বাড়িতে পা দিলেই ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে— আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন নজরুল সরকার। অন্য চার ভাই, রেজাউল, মেহতাব, আলাউদ্দিন এবং আসরাফুল শরীরে আর্সেনিকের বীজ নিয়ে ধুঁকছেন। বেঙ্গালুরু থেকে ফোনে মেহতাব বলছেন, ‘‘কলকাতায় বহু হাসপাতাল ঘুরলাম দাদা। সারল না। চোখের সামনে দেখলাম গ্রামের মানুষ একে একে মারা যাচ্ছেন। শেষ চেষ্টা করাতে এখানে এসেছি।’’ চোখের সামনে এমন মৃত্যু মিছিল দেখেছেন গ্রামের অনেকেই।


বিল্লাল হোসেন। আর্সেনিক দূষণের শিকার।

ছোট থেকে পাঠ্যে যে জলকে জীবন বলে পড়ে এসেছে সইদা, তার সামনেও প্রশ্নটা বুজকুড়ি কাটছে—‘‘কেন আম্মা সব সময় জল খাইতে নিষেধ করে?’’

উত্তরটা জানেন না ওঁরা কেউই। বিডিও থেকে স্বাস্থ্য দফতর, পা দিলে ফিরে এসেছে উত্তর— ফান্ড নেই। এমএসডিপি থেকে এনআরইজি, আর্সেনিক নিয়ে তারাও একরম নীরব। হরেকৃষ্ণপুরের গ্রামবাসীরা বলছেন, ‘‘আসলে কী জানেন, জলঙ্গি সিপিএম পরিচালিত পঞ্চায়েত সমিতি তো তাই সরকারি সাহায্য প্রায় থমকে গিয়েছে।’’ সমিতির সভাপতি সিপিএমের সাইফুল মোল্লা বলেন, ‘‘এক দিকে আর্সেনিকের দাপট, অন্য দিকে সরকারের নীরবতা। কোনও চিকিৎসাই পাচ্ছেন না গ্রামের মানুষগুলো। মশা-মাছির মতো পট পট করে মরছে।’’

আর্সেনিকের দাপট কমাতে গ্রামে কতকগুলি গভীর টিউবয়েলের বসানো হয়েছিল। তবে গ্রাম জুড়ে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, সে সব অধিকাংশই মুখ থুবড়ে পড়েছে। আর্সেনিক মুছতে বছর কয়েক আগে গ্রামে একটি সজলধারা প্রকল্প গ্রামের এক প্রান্তে পানীয় জলের ব্যবস্থা হলেও তাতেও ধরা পড়েছে আর্সেনিক। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর বিষয়টি জানানো হয়েছিল বটে, তবে ওইটুকুই, গ্রাম ঘুরে দেখতেও ওই দফতরের কোনও কর্তাই আসেননি।

উদ্বেগ অবশ্য ধরা পড়েছে খয়রামারি পঞ্চায়েত প্রধান কংগ্রেসের হাদিকুল ইসলামের গলায়, ‘‘কেবল হরেকৃষ্ণপুর নয়, খয়রামারি এলাকার তিন-তিনটি গ্রামের জল একেবারে বিষ হয়ে গিয়েছে।’’ তিনি জানান, দক্ষিণ খয়রামারি, পাজরাপাড়া ও হরেকৃষ্ণপুর এই ৩ গ্রামের গত কয়েক বছরে অন্তত ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে আর্সেনিকে। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘কথাটা জেলা পরিষদ থেকে ব্লকের বিভিন্ন সভায় বার বার তুলেছি। এমনকী কিছু দিন আগে মহকুমায় ওয়াটার অ্যাণ্ড স্যানিটেশন নিয়ে এক সভাতেও বিষয়টি উত্থাপন করেছি। কিন্তু, কেউ পাত্তাই দিলেন না।’’


আক্কাস মণ্ডল। আর্সেনিক দূষণের শিকার।

হরেকৃষ্ণপুরের বাসিন্দা ফিরোজা সরকার জলঙ্গি পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএমের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ। আর্সেনিকে আক্রান্ত স্বামীকে নিয়ে এখন বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি হাসপাতালে আছেন তিনি। তার কথায়, ‘‘হরেকৃষ্ণপুর গ্রামে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মানুষের বাস। গ্রামের ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত। কেউ চিকিৎসা করাচ্ছেন, কেউ বা হাল ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায়।’’ ডোমকলের মহকুমাশাসক তাহিরুজ্জামান বলছেন, ‘‘ওই এলাকা থেকে কিছু দিন আগে এমন একটা আর্সেনিক আক্রান্তের খোঁজ পেয়েছি। তার বেশি কিছু জানি না।’’ গ্রামবাসীরা ধরিয়ে দিচ্ছেন— প্রশাসন জানে না বলেই আজ খয়রামারির
এই হাল।

বছর পঞ্চান্নর আক্কাস মণ্ডলের আস্ত ডান পা’টাই বাদ দিতে হয়েছে। বলছেন, ‘‘আর্সেনিক একেবারে খেয়ে ফেলেছিল পা’টা। তা নিয়েই কাজ করছি।’’ আক্কাসের মতোই ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে রয়েছে খয়রামারি। বলছেন, ‘‘এই বার দেখা পেলেন, বছর কয়েক পরে আসবেন, দেখবেন গাঁ খাঁ খাঁ করছে! নিশ্চুপেই মরে যাবে খয়রামারি।’’

—নিজস্ব চিত্র।

arsenic nabadwip
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy