Advertisement
E-Paper

সামনে কি আরও ভাঙন, অকাল-চ্যালেঞ্জে তৃণমূল

ভাঙনের মুখে আপাতত বোল্ডার ফেলতে হবে! আজ, শুক্রবার দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে এই নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই নামতে হচ্ছে শাসক দলকে। সারদা-কাণ্ডের ছায়ায় ভোট এ রাজ্যে আগেও হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন, লোকসভা নির্বাচন এবং কয়েক মাস আগে দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও খালি হাতে ফেরেনি তৃণমূল। কিন্তু দুর্নীতির মামলায় এক জন পূর্ণমন্ত্রী জেলে, রাস্তাঘাটে লোকে সারদা নিয়ে কটূক্তি করছে বলে জেরবার হওয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দল ছেড়ে বিজেপি-তে গিয়েছেন আর এক মন্ত্রী, এক সাংসদ জামিন পেয়ে বেরিয়েই দল ছেড়ে দিয়েছেন এমন ল্যাজেগোবরে অবস্থায় ইতিপূর্বে আর কোনও নির্বাচনের মোকাবিলা করতে হয়নি তাদের!

সন্দীপন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৪:২১
ভোটপ্রস্তুতি। বৃহস্পতিবার রানাঘাট কলেজে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

ভোটপ্রস্তুতি। বৃহস্পতিবার রানাঘাট কলেজে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

ভাঙনের মুখে আপাতত বোল্ডার ফেলতে হবে! আজ, শুক্রবার দুই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে এই নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই নামতে হচ্ছে শাসক দলকে।

সারদা-কাণ্ডের ছায়ায় ভোট এ রাজ্যে আগেও হয়েছে। পঞ্চায়েত নির্বাচন, লোকসভা নির্বাচন এবং কয়েক মাস আগে দু’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও খালি হাতে ফেরেনি তৃণমূল। কিন্তু দুর্নীতির মামলায় এক জন পূর্ণমন্ত্রী জেলে, রাস্তাঘাটে লোকে সারদা নিয়ে কটূক্তি করছে বলে জেরবার হওয়ার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দল ছেড়ে বিজেপি-তে গিয়েছেন আর এক মন্ত্রী, এক সাংসদ জামিন পেয়ে বেরিয়েই দল ছেড়ে দিয়েছেন এমন ল্যাজেগোবরে অবস্থায় ইতিপূর্বে আর কোনও নির্বাচনের মোকাবিলা করতে হয়নি তাদের! দলে প্রবল অস্থিরতার মধ্যেই নানা ঘাটের জল মাপছেন একাধিক মন্ত্রী-সাংসদ। শাসক দলের তরী ডুবছে, এমন কোনও ইঙ্গিত ভোটযন্ত্রে ফুটে উঠলেই ভাঙনের ঘণ্টা আরও জোরে বাজবে! এমন চাপের মুখে দাঁড়িয়েই উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ লোকসভা ও নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে জনমতের মুখোমুখি হচ্ছে তৃণমূল।

মুুকুল রায় থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের সব নেতাই এক বাক্যে দাবি করছেন ‘অঘটনে’র কোনও সম্ভাবনা নেই! দুই কেন্দ্রই দখলে থাকবে শাসক দলের। কিন্তু ভিতরে ভিতরে এত স্বস্তিতে নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! তিনি জানেন, কোণঠাসা হয়ে-পড়া দলে ‘বিভীষণ’দের আবির্ভাব ঘটেছে! কে কখন কোথায় কার হয়ে কী কাজ করে দেবে, কোনও স্থিরতা নেই। সেই ভয়েই দলের বিক্ষুব্ধ নেতাদের উপনির্বাচনের প্রচারের দায়িত্বে জড়িয়ে দিয়েছিলেন মমতা। তাতেও পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের ঘটেনি! এখন উপনির্বাচনের ফল দেখেই দলের গতিপথ বিচার করতে পারবেন তৃণমূল নেত্রী। দলের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “উপনির্বাচনের কাজে কিছু নেতা-কর্মী যে বিশেষ গা লাগাননি, দেখাই গিয়েছে। দুই কেন্দ্রে জয়ের পরে এঁদের নিয়ে হেস্তনেস্ত করার জায়গায় যাওয়া যাবে। কারণ, তত ক্ষণে দলনেত্রী বুঝে যাবেন, জনমত কতটা তাঁর দিকে।”

নাম না করলেও দলের একাংশের আশঙ্কা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও তাঁর অনুগামীদের নিয়েই। পাঁচ মাস আগে দুই বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের সময় বসিরহাটের অদূরে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিলেন মুকুল। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা ছিল তাঁরই হাতে। শেষ পর্যন্ত বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রটি বিজেপি জিতেছিল ঠিকই কিন্তু দলের পিছিয়ে পড়ার ব্যবধান লোকসভা ভোটের চেয়ে অনেকটাই কমিয়ে এনেছিলেন মুকুলেরা। সারদায় সিবিআই জেরা-ফেরত মুকুল এ বারের উপনির্বাচনে প্রচার করেছেন নামমাত্র। বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রের যে অংশ নদিয়া জেলায় পড়ে, সেখানে মুকুল-পুত্র শুভ্রাংশুর তৎপরতাও তেমন ভাবে চোখে পড়েনি। দলের মধ্যে মুকুলের হাত থেকে বহু সাংগঠনিক দায়িত্বই সরিয়ে নিয়ে ‘যুবরাজ’ অভিষেকের উপরে অর্পণ করেছেন তৃণমূল নেত্রী। উপনির্বাচন দেখভালেও অভিষেক এ বার মাথা ঘামিয়েছেন বেশি। যে ভাবে তিনি তৃণমূল ভবনে গিয়ে মুকুলের পুরনো জায়গায় বসছেন, সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের শিবির যে তাঁকে ভাল ভাবে নেয়নি এ কথাও তৃণমূলের অন্দরে অজানা নয়। তাই দলেই চর্চা চলছে, মুকুল-অভিষেক দ্বৈরথের জের তৃণমূলের ভোট-ভাগ্য এ দিক-ও দিক করে দেবে না তো?

মুকুল অবশ্য এ সব জল্পনা এক বাক্যে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁর সাফ কথা, তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এখনও অনুগত সৈনিক। ভোটের কাজে তাঁর যা করার ছিল, করেছেন। পাশাপাশিই তাঁর যুক্তি, “ভোট এলেই সারদা-সারদা আলোচনা শুরু হয়! এই নিয়ে তিনটি নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কোন দিকে আছেন। সুতরাং, এই নিয়ে হইচই করে লাভ নেই!” অভিষেকও দাবি করছেন, দলে কোথাও এমন কোনও সমস্যা নেই, যা ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে।

কিন্তু মমতা জানেন, সাবধানের মার নেই! দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরীবালের সদ্য-সাফল্যে তৃণমূল নেত্রীর আত্মহারা হয়ে পড়াকে দলে অবিশ্বাসের বাতাবরণের দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করছেন কেউ কেউ। দলের এক নেতার কথায়, “দিল্লি আর পশ্চিমবঙ্গের ভোটের যে সম্পর্ক নেই, এটা কে না জানে! কিন্তু দিল্লিতে আপের জয়ের কথা দলনেত্রী এত বেশি করে বলছেন বিজেপি-র বিরুদ্ধে বার্তা দিতে। দলের যে নেতা-কর্মীরা অন্য রকম ভাবছেন, তাঁদের উনি বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, বিজেপি-র বেলুন ফুটো হতে শুরু করেছে!”

আপে’র হাতে বিজেপি-র বেলুন ফুটো হওয়ার কথা এখন যে বারবার বলতে হচ্ছে, তার একটা কারণ নিহিত আছে সংখ্যাতত্ত্বেও। যে সংখ্যাতত্ত্ব বলছে, বনগাঁ কেন্দ্রে ৮ মাস আগের লোকসভা ভোটে তৃণমূল পেয়েছিল প্রায় ৪৩% এবং সিপিএম সাড়ে ৩১% ভোট। তার আগের লোকসভা ভোটের তুলনায় দু’দলের ভোট কমেছিল যথাক্রমে ৭.৭৫% এবং ১০%। সেখানে বিজেপি আগের বারের তুলনায় প্রায় ১৫% বাড়িয়ে পেয়েছিল ১৯% ভোট! কৃষ্ণগঞ্জে বিজেপি-র রেখচিত্রও কম চমকপ্রদ নয়! সিপিএমকে (৪০.৮৬%) হারিয়ে ২০১১ সালে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট প্রার্থী যখন জিতেছিলেন ৫২% ভোট পেয়ে, বিজেপি-র জুটেছিল মাত্র ৩%! পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গত বছরের লোকসভা ভোটে কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভায় সেই বিজেপি-রই ভোট বেড়ে হয়েছে সাড়ে ১৪%। তৃণমূলের (৪৯%) সঙ্গে অনেকটা ব্যবধান থাকলেও বিজেপি-র উত্থানের গতিই এখানে চোখে পড়ার মতো! এর মানে অবশ্যই এই নয় যে, রাতারাতি সব হিসেব উল্টে গিয়ে দুই কেন্দ্রেই তৃণমূলের পতন হতে পারে। কিন্তু দলের মধ্যে অন্তর্ঘাতকে ‘বিজেপি-হাওয়া’ বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকছে বিলক্ষণ! শাসক দলের মধ্যে ভয় সেখানেই! আর আতঙ্ক উস্কে দিয়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলছেন, “ফল প্রত্যাশা মতো না হলেই তৃণমূলে অস্থিরতা আরও বাড়বে। দমবন্ধ অবস্থা থেকে বেরনোর জন্য অনেকে তৈরি, আগেই বলেছি। ভোটের পরে সেটা স্পষ্ট দেখা যাবে!”

তৃণমূল দিল্লির দৃষ্টান্ত টানলেও ইতিহাস বলছে, রাজ্যওয়াড়ি নির্বাচনের বিষয় আলাদা হয়। তার উপরে উপনির্বাচনে ভোট হয় আরও স্থানীয় কিছু প্রশ্নে। উপনির্বাচন মানে সচরাচর শাসক দলের পক্ষেই অনুকূল, সেটাও স্বাভাবিক ঘটনা। তবু এ বারের জোড়া উপনির্বাচনকে শেষ লগ্নে অন্য মাত্রায় তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে আপ-ধাক্কার চোটেই! তৃণমূল নেত্রীর যে চেষ্টাকে অবান্তর বলেই মনে করছেন বিজেপি নেতারা। দলের তরফে এ রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ যেমন হিন্দির চলতি প্রবচন ব্যবহার করে বলছেন, “বেগানোঁ কি শাদি মে আবদুল্লা দিওয়ানা!” তাঁর যুক্তি, এক রাজ্যের ভোট অন্য রাজ্যে ছাপ ফেললে হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড বা মহারাষ্ট্রে সাফল্যের স্রোতে বিজেপি দিল্লিকেও ভাসিয়ে নিতে পারত! বাংলায় সিপিএমকে হারানোর পরে ‘পরিবর্তনে’র স্লোগান নিয়ে মমতাই বা ত্রিপুরায় ব্যর্থ হয়েছিলেন কেন?

তৃণমূলের যেমন দলে ভাঙনের ভয়, সিপিএমের তেমনই উদ্বেগ ভোটব্যাঙ্কে ভাঙনের! বাম নেতৃত্ব জানেন, তৃণমূলের বিড়ম্বনার বাজারে বিজেপি-র থাবা থেকে নিজেদের লোকসভা ভোটের ভাগটুকু বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই স্বস্তি অনেক। আটকানো যাবে অবিরত রক্তক্ষরণের আতঙ্ক! পরিস্থিতি বুঝে সিপিএম নেতৃত্ব চাইছেন, তৃণমূল এবং বিজেপি, দু’দলের বিরুদ্ধেই বার্তা দেওয়ার জন্য এই অকাল-ভোটকে ব্যবহার করতে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যুক্তি, নৈরাজ্য, অপশাসন এবং দুর্নীতির জেরে তৃণমূল রাজ্য শাসনের ‘নৈতিক অধিকার’ হারিয়েছে। আর বিজেপি চেষ্টা করছে এই পরিস্থিতিকে ‘বিষাক্ত’ করে তুলতে। মোট ৮টি বিধানসভা কেন্দ্রের ১৭ লক্ষ ভোটারের কাছে তাই তাঁদের আবেদন, ‘জোড়া বিপদ’কে ঠেকাতে আজ ভোটযন্ত্রকে ব্যবহার করুন!

sandipan chakrabarty vote bangaon krishnagaunje
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy