Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

টাওয়ার নেই ফোনে? টাকা ঠিক আছে তো

বেশি দিন আগের কথা নয়। এক রাতে কালীঘাটের বাসিন্দা নিগম সোনি দেখলেন, তাঁর মোবাইলের টাওয়ার উধাও। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত টাওয়ার না আসায় সংশ্লিষ্ট টেলিকম সংস্থার ‘আউটলেট’ (সংস্থার অধীনে থাকা বড় দোকান)-এ ছুটলেন নিগম।

অভীক় বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৩
Share: Save:

বেশি দিন আগের কথা নয়। এক রাতে কালীঘাটের বাসিন্দা নিগম সোনি দেখলেন, তাঁর মোবাইলের টাওয়ার উধাও। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত টাওয়ার না আসায় সংশ্লিষ্ট টেলিকম সংস্থার ‘আউটলেট’ (সংস্থার অধীনে থাকা বড় দোকান)-এ ছুটলেন নিগম। গিয়ে যা শুনলেন, তাতে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। সংস্থার কর্মীরা জানালেন, স্বয়ং ‘নিগম সোনি’ই নাকি তাঁর সিমকার্ডটি ভেঙে গিয়েছে বলে জানিয়ে আগের দিন ‘ডুপ্লিকেট’ সিম তুলে নিয়েছেন! ‘আসল’ নিগমের পরিচয় পেয়ে অবশ্য ভুল ভাঙল তাঁদের। কিন্তু তত ক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। অন্য একটি সিমে নিগমের নম্বরটি চালু করা মাত্রই পরপর আসা এসএমএস জানিয়ে দিল, নিগমের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে চার দফায় তুলে নেওয়া হয়েছে মোট ১৪ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা!

লালবাজার সূত্র জানাচ্ছে, পরে ধরা পড়েছিল নিগমের টাকা হাতানো তিন জালিয়াত। কিন্তু ব্যাঙ্ক জালিয়াতির এই নতুন পন্থাটা এখন ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যেই কলকাতার একাধিক ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনায় সিমকার্ড জালিয়াতির নজির পেয়েছেন গোয়েন্দারা।

নেট ব্যাঙ্কিংয়ের টাকা হাতাতে সিমকার্ড জাল করা হচ্ছে কেন?

পুলিশ জানাচ্ছে, এর উদ্দেশ্য একটাই— নেট ব্যাঙ্কিং করার সময়ে প্রয়োজনীয় ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড’ (ওটিপি) হাতানো। জালিয়াতি এড়াতেই গ্রাহকের মোবাইলে ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড’ পাঠানোর ব্যবস্থা রেখেছে ব্যাঙ্কগুলি। অর্থাৎ গ্রাহক যখনই নেট ব্যাঙ্কিং করবেন, তখনই তাঁর মোবাইলে ব্যাঙ্কের তরফে এসএমএস করে প্রতি বার একটি নতুন পাসওয়ার্ড পাঠানো হবে। সেই পাসওয়ার্ড মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য বৈধ থাকে। সেটি ব্যবহার করে তবেই নেট ব্যাঙ্কিং করা যায়।

ব্যতিক্রমও অবশ্য আছে। কিছু ব্যাঙ্কে নেটের মাধ্যমে টাকা লেনদেনের জন্য পরিচিত অ্যাকাউন্টের একটি তালিকা তৈরি করে রাখা যায়। ধরা যাক, কোনও ব্যক্তি তাঁর বাবা, মা কি স্ত্রীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মতো কিছু অ্যাকাউন্টে নিয়মিত টাকা ট্রান্সফার করেন। মোবাইলে ফেভারিট কল লিস্ট তৈরি করার মতোই নেট ব্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রে এই অ্যাকাউন্ট নম্বরগুলি নিয়ে তিনি একটি ‘বেনিফিশিয়ারি লিস্ট’ তৈরি করে রাখতে পারেন। এই তালিকায় প্রতি বার নতুন কোনও অ্যাকাউন্ট নম্বর সংযোজনের সময়ে একটি করে ‘ওটিপি’ প্রয়োজন হয়। কিন্তু তার পর থেকে ওই বেনিফিশিয়ারি লিস্ট-এর অন্তর্ভুক্ত অ্যাকাউন্টগুলিতে টাকা লেনদেনের সময় আর নতুন করে ‘ওটিপি’ লাগে না। তবে কিছু ব্যাঙ্কে টাকা লেনদেনের জন্য সব সময়ই ‘ওটিপি’ প্রয়োজন হয়।

কিন্তু জালিয়াতের ‘ওটিপি’ ছাড়া গতি নেই। কারণ তাদের অ্যাকাউন্ট তো গ্রাহকের ‘বেনিফিশিয়ারি লিস্ট’-এ থাকবে না। তা ছাড়া এই সিম জালিয়াতির আরও একটা উদ্দেশ্য হল, লেনদেন সম্পূর্ণ হওয়ার পর গ্রাহকের নথিভুক্ত নম্বরে ব্যাঙ্কের এসএমএস আসে। সিম জালিয়াতি করা হলে সেই মেসেজ-ও গ্রাহক পাবেন না। অনেক ক্ষেত্রে এসএমএসের পাশাপাশি ই-মেলেও লেনদেনের কথা জানানো হয়। কিন্তু পুলিশের অনেকে বলছেন, ই-মেল অনেক সময় নজর এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু ধরে নেওয়া যায়, গ্রাহক এসএমএস দেখবেনই। কাজেই সিম জালিয়াতি করলে পুরোপুরি গ্রাহকের নজর এড়িয়ে তাঁর অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেওয়া সম্ভব। এ সবের আগে অবশ্য গ্রাহকের নেট ব্যাঙ্কিং অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে তাঁর আইডি, পাসওয়ার্ড ইত্যাদি হাতাতে হয় জালিয়াতদের। সিম জালিয়াতি আসলে দ্বিতীয় ধাপ। কিন্তু সেই দ্বিতীয় ধাপই ইদানীং বেশি ভাবাচ্ছে সাইবার বিশেষজ্ঞ ও পুলিশকর্তাদের। কারণ শুধু ব্যাঙ্ক থেকে টাকা হাতানো নয়, সিম জাল করে আরও বড় অপরাধ বা নাশকতা পর্যন্ত ঘটানো যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।

কী ভাবে জাল করা হয় সিম?

নিগম সোনির ঘটনা যে ভাবে ঘটছিল, সচরাচর সেই ভাবেই। পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, জালিয়াতেরা যে গ্রাহককে ‘নিশানা’ করে, তাঁর নথিভুক্ত ফোন নম্বরের সিমকার্ডটি হারিয়ে গিয়েছে বা ভেঙে গিয়েছে বলে জানিয়ে সংশ্লষ্ট টেলিকম সংস্থার ‘আউটলেট’-এ যোগাযোগ করে তারা। গ্রাহকের ভেক ধরে ‘ডুপ্লিকেট’ সিম চায়। নতুন সিম তোলার জন্য যে জাল পরিচয়পত্র দেওয়া হয়, তাতে অস্পষ্ট ছবি থাকে। এমনকী অনেক সময়ে সিম হারিয়েছে বলে দাবি করে পুলিশে ভুয়ো জেনারেল ডায়েরি পর্যন্ত করে জালিয়াতেরা! লালবাজারের এক কর্তা জানান, বছর তিনেক আগে দেবাশিস দত্ত নামে এক ব্যক্তির ফোন চুরির অভিযোগ জানিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার একটি থানায় ভুয়ো ডায়েরি করা হয়েছিল। ডুপ্লিকেট সিম তোলার সময় সেই ডায়েরির প্রতিলিপিও জমা দিয়েছিল জালিয়াতেরা, সঙ্গে অস্পষ্ট ছবি সমেত জাল পরিচয়পত্র। নিগম সোনির ক্ষেত্রে পুলিশে ডায়েরি হয়নি, তবে ভুয়ো পরিচয়পত্রে অস্পষ্ট

ছবি ছিল। পুলিশ বলছে, নিয়ম অনুযায়ী, অস্পষ্ট ছবি-সহ পরিচয়পত্রে ‘ডুপ্লিকেট সিম’ দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু টেলিকম সংস্থাগুলির কর্মীদের একাংশের ‘গাফিলতি’তেই এমন পরিচয়পত্র দিয়ে সিম পাচ্ছে জালিয়াতেরা। কখনও কখনও টেলিকম সংস্থার কর্মীরাও জালিয়াতি চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন। তা হলে পুলিশ কিছু করছে না কেন?

কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘সিম জালিয়াতির অভিযোগ না পেলে আমরা কিছু করতে পারি না। টেলিকম দফতরেরই উচিত বিভিন্ন টেলিকম সংস্থা, ডিস্ট্রিবিউটর ও খুচরো বিক্রেতারা ঠিকমতো সিম বিক্রি করছেন কি না, তা যাচাই করা।’’ আবার টেলিকম দফতরও জানিয়েছে, অভিযোগ ছাড়া জালিয়াতি জানা তাদের পক্ষে অসম্ভব। নথি যাচাই না করেই কেন সিম দেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে টেলিকম সংস্থাগুলির সংগঠন সেলুলার অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া-র কাছে কোনও সদুত্তর মেলেনি। তবে সিম জালিয়াতির দায় যে কিছুটা হলেও সংস্থার উপরে বর্তায়, তা মানছেন সংগঠনের ডিজি রাজন এস ম্যাথুজ। তাঁর দাবি, জালিয়াতি ঠেকাতে সরকারের টেলিকম দফতর ও পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে টেলিকম শিল্পমহল। পরিষেবা দেওয়ার লাইসেন্সের চুক্তি অনুযায়ী, এ ধরনের ঘটনায় টেলিকম সংস্থাগুলিও পুলিশের কাছে অভিযোগ করে। রাজন বলেন, ‘‘জালিয়াতি ঠেকাতে আধার তথ্যের ভিত্তিতে সিম কার্ড চালুর ব্যাপারে কলকাতা-সহ দেশের চারটি শহরে পাইলট প্রকল্প শেষ হয়েছে।’’

পুলিশের অনেকে অবশ্য বলছেন, টেলিকম সংস্থার তৎপরতার পাশাপাশি গ্রাহকদের সচেতনতাটাও ভীষণ জরুরি। কারণ সিম জাল করার আগে জালিয়াতদের তো ‘শিকার’-এর নেট ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত গোপন তথ্যাদি হাতাতে হয়। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, এই সমস্ত গোপনতম তথ্য— নেট ব্যাঙ্কিং অ্যাকাউন্ট আইডি, অ্যাকাউন্ট নম্বর কিংবা পাসওয়ার্ড স্রেফ গ্রাহকদের অসচেতনতার জন্যই চলে গিয়েছে জালিয়াতদের হাতে।

কী ভাবে হয় সেটা?

গোয়েন্দা ও সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কম্পিউটার বা স্মার্টফোন থেকে নেট ব্যাঙ্কিং করা হচ্ছে, তাতে গ্রাহকের অজান্তেই ভাইরাস বা ম্যালওয়ার প্রোগ্রাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেই সব ভাইরাস প্রোগ্রাম নেট ব্যাঙ্কিংয়ের আইডি, পাসওয়ার্ড-সহ তাঁর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জালিয়াতদের কাছে পৌঁছে দেয়। বিভিন্ন সন্দেহজনক এবং অশ্লীল ওয়েবসাইট মারফতই এ সব ভাইরাস ছড়ানো হয়। লটারি বা বন্ধুত্বের ই-মেল থেকেও ভাইরাস ছড়ায় (নিগম সোনির ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর অফিসের এক সহকর্মী এই সব তথ্য চুরি করেছিল বলে তদন্তকারীরা জানান)। তাই পুলিশের পরামর্শ, নেট ব্যাঙ্কিং করার আগে সুরক্ষার ধাপগুলি ভাল ভাবে জেনে নিতে হবে।

সাইবার বিশেষজ্ঞ ও পুলিশকর্তাদের একাংশ একই সঙ্গে দ্বিতীয় বিপদটার কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, সিম জালিয়াতি বাড়তে থাকলে বিদেশি শক্তি ও জঙ্গিরাও এর সুবিধে নিতে পারে। সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়ের মতে, জঙ্গিরা এ ভাবে কোনও নিরীহ নাগরিকের নামে ডুপ্লিকেট সিম তুলে ব্যবহার করতে পারে। তার ফলে নাশকতার ঘটনায় প্রথমেই ওই নিরীহ নাগরিক গোয়েন্দাদের হাতে অকারণ হেনস্থা হতে পারেন। তাই জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারেরও সিম জালিয়াতি নিয়ে অবিলম্বে সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE