Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কয়লা চুরি করতে নেমে খাদানেই আটক ৩৬ ঘণ্টা

পুলিশ যে এসে গিয়েছে, তা ওঁরা বুঝতে পারেননি। উপরে যারা পাহারায় ছিল, কিছুক্ষণের জন্য সরে গিয়েছিল। পুলিশ যখন খাদানে মুখ বাড়িয়ে হাঁক দেয়, ভয়ে ওঁরা লুকিয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ মাটি-পাথর দিয়ে খনিমুখ ভরাট করে ফিরে যায়।

নীলোৎপল রায়চৌধুরী
জামুড়িয়া শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০২:১৪
Share: Save:

পুলিশ যে এসে গিয়েছে, তা ওঁরা বুঝতে পারেননি।

উপরে যারা পাহারায় ছিল, কিছুক্ষণের জন্য সরে গিয়েছিল।

পুলিশ যখন খাদানে মুখ বাড়িয়ে হাঁক দেয়, ভয়ে ওঁরা লুকিয়ে পড়েছিলেন। পুলিশ মাটি-পাথর দিয়ে খনিমুখ ভরাট করে ফিরে যায়।

৩৬ ঘণ্টা পরে জামুড়িয়ায় অবৈধ খাদানের গহ্বর থেকে অবশ্য জীবন্তই ফিরেছেন কয়লা চুরি করতে নামা ছয় যুবক। ইসিএলের সাহায্য ফিরিয়ে দিয়ে, নিজেরাই গর্ত খুঁড়ে প্রায় মেঠো পদ্ধতিতে এলাকার লোকজন তাঁদের তুলে আনেন। তাঁরা আসানসোলের কাল্লা হাসপাতালে ভর্তি।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, শুক্রবার ভোর ৫টা নাগাদ বর্ধমানের জামুড়িয়ায় পরিহারপুর এলাকায় কুয়ো খাদানে কয়লা কাটতে নেমেছিলেন ছয় যুবক। সকাল ১১টা নাগাদ পুলিশ গিয়ে ডোজার দিয়ে তা ভরাট করে দেয়। ৬০ ফুট নীচে খনির সুড়ঙ্গে আটকে পড়েন শেখ ফুরহান, শেখ হাব্বুল, শেখ সাবের আলি, শেখ তাজবুল, শেখ নবি হোসেন ও শেখ রবিউল নামে ছ’জন। রাতে তাঁরা বাড়ি না ফেরায় গ্রামবাসীরা প্রমাদ গোনেন। মাটি কাটার যন্ত্র এনে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। বাইশ ঘণ্টার চেষ্টায়, শনিবার বিকেল সওয়া ৫টা নাগাদ এক-এক করে বের করা হয় ছ’জনকে।

কিন্তু নীচে ছ’জন থাকা সত্ত্বেও পুলিশ খনিমুখ বুজিয়ে দিল কী ভাবে?

স্থানীয় সূত্রের দাবি, পরিহারপুরের দশ জন সে দিন খাদানে গিয়েছিলেন। চার জন উপরে পাহারা দিচ্ছিলেন। সকাল ১১টা নাগাদ তাঁরা তাজবুলদের জানান, কিছুক্ষণ ঘুরে আসছেন। গোল বাধে এর পরেই। এসিপি (সেন্ট্রাল) শৌভনিক মুখোপাধ্যায় এবং এডিসিপি (সেন্ট্রাল) বিশ্বজিৎ ঘোষের নেতৃত্বে খাদান ভরাট করতে যায় পুলিশ। সাধারণত পুলিশ এলে কয়লাচোরেরা আগাম খবর পেয়ে যায়। পুলিশের দাবি, খনিমুখে কাউকে না দেখে তারা ভেবেছিল, নীচে কেউ নামেনি। তা সত্ত্বেও খাদানের মুখে চিৎকার করে জানতে চাওয়া হয়, নীচে কেউ আছে কি না। সাড়া না মেলায় খনিমুখ আটকে দেওয়া হয়।

গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, সন্ধ্যায় তাঁরা পুলিশে খবর দেন, ছ’জন নীচে আটকে পড়েছেন। কিন্তু পুলিশ আমল দেয়নি। শেষে নিজেরাই জেসিবি মেশিন এনে তাঁরা ভরাট করা মাটি তুলতে শুরু করেন। পরে পুলিশের বড় বাহিনী এসে পৌঁছোয়। রাতেই এক গ্যাস উত্তোলক সংস্থার সাহায্য নিয়ে খনিমুখ ঘিরে তিনটি ‘বোর হোল’ (সরু গর্ত) খোঁড়া হয়। সেই গর্ত দিয়ে ডাকাডাকি করার পরে নীচ থেকে সাড়া মেলে। তাজবুলেরা জানান, তাঁরা বেঁচে রয়েছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাঁদের উপরে তোলার ব্যবস্থা করতে আর্জি জানান তাঁরা। রাতভর মাটি তোলার কাজ চলে। পাশের গর্ত দিয়ে পাঠানো হতে থাকে জল, গ্লুকোজ, বিস্কুট।

শনিবার সকালে বৃষ্টি নামায় বেশ কিছু ক্ষণ উদ্ধারের কাজ বন্ধ থাকে। অনেক দিন পরে বৃষ্টি হওয়ায় খনিগর্ভ গরম হয়ে ওঠে। নীচ থেকে আটকে পড়া যুবকেরা জানাতে থাকেন, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। গ্রামবাসীরা জেনারেটর এনে বোর হোল দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে নীচে হাওয়া পাঠাতে থাকেন। বেলা গড়াতে একে-একে ঘটনাস্থল ঘুরে যান আসানসোল কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী বংশগোপাল চৌধুরী এবং কংগ্রেসের ইন্দ্রাণী মিশ্র। উদ্ধারাকাজে পুলিশ কার্যত নীরব দর্শক বলে অভিযোগ তোলেন বংশগোপাল। দুপুর পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ছিলেন খনি এলাকার তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটকও। তিনি অবশ্য বলেন, “তাড়াহুড়ো করলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। তাই সময় লাগছে।”

দুপুরে এসে পৌঁছয় ইসিএলের উদ্ধারকারী দল। কিন্তু ততক্ষণে বেশির ভাগ কাজ হয়ে যাওয়ায় গ্রামবাসী তাদের ফিরিয়ে দেন। খনিমুখ থেকে মাটি-পাথর তুলে ফেলার পরে বিকেলে বড় ঝুড়ি নামিয়ে এক-এক করে উপরে তোলা হয় ছ’জনকে। পরে কাল্লা হাসপাতালে শুয়ে নবি হোসেন বলেন, “কয়লা কাটার সময়ে হঠাৎ উপর থেকে মাটি-পাথর পড়তে দেখে সুড়ঙ্গে আমরা সেঁধিয়েছিলাম। খনিমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আতঙ্ক চেপে বসে। চারপাশে এত অন্ধকার, মনে হচ্ছিল মরেই যাব।” ফুরহান, হাব্বুলেরা বলেন, “রাতে যখন উপরে গ্রামের লোকের গলার আওয়াজ পেলাম, তখনই প্রথম মনে হল, আশা আছে। তার পর থেকে নীচে আমরাও সারাক্ষণ সুড়ঙ্গ থেকে হাত লাগিয়ে মাটি সরানোর চেষ্টা করে গিয়েছি।”

আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল অবশ্য পুলিশের গাফিলতি মানতে চাননি। তিনি বলেন, “অবৈধ খননের খবর পেয়ে তা বন্ধ করা হয়েছে। পুলিশ আওয়াজ দিয়েছিল। কোনও জবাব না মেলায় খনিমুখ বন্ধ করেছে।” উদ্ধারকাজে যে পুলিশ কোনও সাহায্য করেনি, তা-ও তিনি মানতে চাননি। ইসিএলের সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায়েরও দাবি, “কয়লা চুরি করতে নেমে কেউ আটকে পড়লে আমাদের উদ্ধার করতে যাওয়ার কথা নয়। তা-ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হয়েছে।”

(সহ-প্রতিবেদন: শৈলেন সরকার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

coal pit nilotpal roychowdhury
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE