Advertisement
E-Paper

মুহূর্তে বদলে গেল উৎসবের মেজাজ

মন্দির লাগোয়া মাঠটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে নাগরদোলা, টয়ট্রেন। সুনসান একের পর এক বাড়ির দাওয়ায় বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন জনাকয়েক মহিলা। কয়েক ঘণ্টার ফারাকে যেন ভোলবদল হয়েছে গ্রামের। অথচ সকালেও হুল্লোড় করে তিনটি বাস ভাড়া করে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন শ’তিনেক গ্রামবাসী। তাঁরা ফিরলেই বহু বছরের রেওয়াজ মেনে গাজনের মেলার তোড়জোড় পুরোদমে শুরু হওয়ার কথা ছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৫ ০২:০৫
বাসটি তোলার পরে চলছে উদ্ধার কাজ।

বাসটি তোলার পরে চলছে উদ্ধার কাজ।

মন্দির লাগোয়া মাঠটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে নাগরদোলা, টয়ট্রেন। সুনসান একের পর এক বাড়ির দাওয়ায় বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন জনাকয়েক মহিলা। কয়েক ঘণ্টার ফারাকে যেন ভোলবদল হয়েছে গ্রামের।

অথচ সকালেও হুল্লোড় করে তিনটি বাস ভাড়া করে গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন শ’তিনেক গ্রামবাসী। তাঁরা ফিরলেই বহু বছরের রেওয়াজ মেনে গাজনের মেলার তোড়জোড় পুরোদমে শুরু হওয়ার কথা ছিল। তার মাঝেই একটা বর্ধমান-নাদনঘাট রোডের মির্জাপুরের কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় একটি বাস। মারা যান ১৩ জন। আহত হন আরও জনা কুড়ি। এক লহমায় উৎসবের মেজাজ বদলে যায় শোকে।

প্রতি বছরই চৈত্রের শেষে চার দিনের গাজনের মেলা বসে খণ্ডঘোষের খুদকুড়ি গ্রামে। রাঘবেশ্বর মন্দির লাগোয়া মাঠে নাগরদোলা, টয়ট্রেনের পাশাপাশি রাত জেগে কলকাতা, আরামবাগের যাত্রাদলেরও পালাও চলে। শুক্রবার সেই রীতি মেনেই নবদ্বীপের মায়াপুরে গঙ্গাস্নানে যাচ্ছিলেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু দুর্ঘটনায় পড়ে সবার আর ঘরে ফেরা হল না। মেলার প্রস্তুতি ছেড়ে ঘরের ছেলেদের টানে গ্রামবাসীরা দিনভর ভিড় করলেন বর্ধমান মেডিক্যালে। সন্ধ্যায় প্রশাসনের সাহায্যে দাহ করা হল তাঁদের। গাজন উৎসব কমিটির সদস্য অরবিন্দ পাল বলেন, “দেড়শো বছর ধরে আমাদের গ্রামে চৈত্র মাসের শেষ চারদিন গাজন হয়। নিয়ম করে তার আগে সকলে গঙ্গাস্নান করে আসেন। কিন্তু শুক্রবার যা ঘটে গেল, তাতে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছি।’’

ঘটনার আকস্মিকতা কাটাতে পারছেন না প্রবীণেরাও। অজিত রুইদাস কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “বাপ ঠাকুর্দ্দার আমল থেকে এই গাজন চলে আসছে। আমাদের কাছে দুর্গাপুজোর থেকেও বড় এই উত্‌সব। আশপাশের খান পঞ্চাশেক গ্রামের মানুষও এতে যোগ দেন। কোনওদিন এমন হয়নি। এ বার কেন যে এমন হল!’’ দুই ভাই, উদয় ও হৃদয়কে হারিয়ে কেঁদে আকুল তাঁদের স্ত্রী সরস্বতী ও বীণা। বীণা শুধু ঘোরে বললেন, ‘‘প্রত্যেকবারের মতো এ বারেও আমার স্বামী ও ভাসুর বাসে উঠেছিলেন। এমনটা যে হবে বুঝতে পারিনি!” সরস্বতীর এটুকু বলারও অবস্থা ছিল না। দাওয়ায় ঠেস দিয়ে একটানা কেঁদেই চলেছেন তিনি।

বাসের ছাদ থেকে সময়মতো লাফিয়ে পড়ে বেঁচে গিয়েছে কিশোর মৃন্ময় দাস। তবে দাদা তন্ময়ের আর বাড়ি ফেরা হয়নি। মৃন্ময় বলে, “আমি ছাদেই ছিলাম। তিনটি বাস এক সঙ্গে যাচ্ছিল। দুটি বাস দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়। আমাদের বাসটি পিছিয়ে পড়ছে দেখে চালক প্রচণ্ড গতি বাড়িয়ে দেয়। মির্জাপুরের কাছে বাঁকের মুখে আচমকা টাল খেয়ে যায় বাসটি। রাস্তা থেকে জমিতে পড়ে তিনটি পাল্টি খায়। বাস ডানদিকে হেলে পড়ার সময় আমি কোনওরকমে বাঁ দিকে লাফিয়ে পড়ি।” মৃন্ময়ের মতোই বাসের ছাদ থেকে শেষ মূহুর্তে ঝাঁপ দিয়ে বেঁচে গিয়েছেন আরও কয়েকজন। বাসে ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বিভাস চক্রবর্তীও। খুদকুড়িতে মামারবাড়িতে গিয়েছিল সে। বিভাস বলে, ‘‘আমার মামারবাড়ির মোট ছ’জন গঙ্গাস্নানে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে দাদু সনত্‌ চক্রবর্তী ও আমার মামাতো বোন শুক্লা চক্রবর্তীর মৃত্যু হয়েছে। ওই দু’জন বাসের ছাদেই ছিলেন। তবে আমি সময়মতো ঝাঁপ দিয়েছিলাম। তাই প্রাণে বেঁচে গিয়েছি।” গ্রামবাসী অচিন্ত্য সিংহ, সঞ্জয় পালেরা বলেন, ‘‘আমরা খবর পেয়েই হাসপাতালে দৌড়ই। আশপাশের গ্রামের লোকেরাও সেখানে ছোটেন। হাসপাতালে গিয়ে একটার পর একটা মৃতদেহ দেখে চমকে উঠি। পরিচিত মুখগুলোর দিকে আর তাকাতে পারিনি।”

এ দিন সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ দুর্ঘটনাগ্রস্থদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। গ্রামের লোক, পরিবার, আত্মীস্বজনের সঙ্গে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাদের উপস্থিতিতে থিকথিক করছিল চত্বর। জরুরি বিভাগের সামনেটা রক্তে ভরে গিয়েছিল। আহত রাধারানিদেবী, পরিমল সেনরা বলেন, ‘‘কোনওরকমে প্রাণে বাঁচেছি। চাললকে বারবার আস্তে চালাতে বললেও শোনেনি। তাই তো বেঘোরে প্রাণ গেল এত জনের।’’

রাত পর্যন্ত দাহ কাজেই ব্যস্ত ছিলেন গ্রামবাসীরা। শোকের ছায়ায় উৎসব কীভাবে হবে সেটাই এখন প্রশ্ন। উদাস গলায় কয়েকজন বললেন, ‘‘মেলায় মাতার মন আর নেই। হয়তো পুজোটুকুই হবে।’’

—নিজস্ব চিত্র।

bus accident festive mood burdwan bus accident 13 dead state news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy