Advertisement
০৮ মে ২০২৪

জেদই ভরসা, তাক লাগাল তিন কন্যে

কারও বাবা রুপোর দোকানের কারিগর, কারও ভরসা দিদার সঞ্চিত সামান্য টাকা। কিন্তু বাড়ির ওই পরিবেশটা আটকাতে পারেনি তাদের। বরং তাতেই জেদ চেপে গিয়েছিল তিন কন্যের। সেই জেদের উপর ভর করেই এ বারের মাধ্যমিকে নজরকাড়া ফল করেছে ওরা।

বাঁ দিক থেকে, পদ্মা স্বর্ণকার, কোয়েল সরকার, মেঘা নাগ। নিজস্ব চিত্র।

বাঁ দিক থেকে, পদ্মা স্বর্ণকার, কোয়েল সরকার, মেঘা নাগ। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
দুর্গাপুর ও জামুড়িয়া শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৬ ০১:৫৬
Share: Save:

কারও বাবা রুপোর দোকানের কারিগর, কারও ভরসা দিদার সঞ্চিত সামান্য টাকা। কিন্তু বাড়ির ওই পরিবেশটা আটকাতে পারেনি তাদের। বরং তাতেই জেদ চেপে গিয়েছিল তিন কন্যের। সেই জেদের উপর ভর করেই এ বারের মাধ্যমিকে নজরকাড়া ফল করেছে ওরা।

সিলামপুরে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান রয়েছে মধুসূদন নাগের। সংসারে অভাব নিত্য সঙ্গী বলে জানান মধুসূদনবাবু। তবে অভাবের প্রভাব ছায়া ফেলতে পারেনি মেয়ে মেঘার পড়াশোনায়। এ বারের মাধ্যমিকে সে ৯১ শতাংশ নম্বর পয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সিলামপুর হাইস্কুলের ছাত্রী মেঘা জানায়, ভবিষ্যতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে সে চিকিৎসক হতে চায়। কাঁকসা গার্লস স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবে বলে জানায় সে। তবে অতটা পথ মেয়ে যেতে পারবে কিনা, তানিয়ে খানিক সংশয়ে মধুসূদনবাবু। তাঁর সংশয়, ‘‘এ বার কী হবে জানি না।’’ পাঠ্যক্রমের বাইরে সাহিত্যও বিশেষ পছন্দ মেঘার। প্রিয় লেখক? মেঘা জানায়, সুযোগ পেলেই স্কুলের লাইব্রেরি থেকে আনা রবীন্দ্রনাথ আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ে চোখ বুলোয় সে। মেঘাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্কুলের শিক্ষকরাও। প্রধান শিক্ষক সুকুমার পাল বলেন, ‘‘মেঘা আমাদের স্কুলের গর্ব।’’

জন্ম থেকেই পোলিও আক্রান্ত দুর্গাপুর বি-জোন স্টিল টাউন গার্লস স্কুলের ছাত্রী কোয়েল সরকার। কোয়েলের মা দেবযানীদেবীর অভিযোগ, ‘‘মেয়ে পোলিও আক্রান্ত হওয়ায় ওর বাবা আমাদের সঙ্গে থাকেন না।’’ এক রত্তির মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়িতে উঠেছিলেন দেবযানীদেবী। লড়াইটা শুরু তবে থেকেই। কোয়েলের মামার বাড়ির অবস্থাও যে ভাল নয়। দিদার জমানো টাকানো থেকে কোনও রকমে চলে সংসার। দুই মামারও তেমন রোজগার নেই। তবে ভাগ্নীকে পড়াশোনায় সবসময় উৎসাহ জুগিয়েছেন ছোটমামা। কোয়েলের কথায়, ‘‘ছোটমামা না থাকলে রোজ স্কুলেই যেতে পারতাম না।’’ রোজ স্কুলে গিয়েই কোয়েল এ বারের মাধ্যমিকে প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি নম্বর পেয়েছে। মেয়ের কথা বলতেই দেবযানীদেবীর চোখে জল। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে বলে ফেলেন, ‘‘কোয়েল আমার মুখ রেখেছে।’’ কোয়েল ছবি আঁকতে ভালবাসে। কাগজে তুলির টান দিতে দিতেই সে বলে, ‘‘লড়াই শেষ নয়। আমি চিকিৎসক হতে চাই।’’

কোয়েলের মতোই বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায় জামুড়িয়ার নাগেশ্বর কোলিয়ারি বাসিন্দা পদ্মা স্বর্ণকারও। তার বাবা সন্তোষবাবু রুপোর দোকানে কারিগরের কাজ করেন। মাস গেলে হাতে থাকে অল্প কটা টাকা। তবে তাতে পদ্মার ভাল রেজাল্ট হওয়া আটকায়নি। মাধ্যমিকে তার নম্বর প্রায় ৮৬ শতাংশ। মেঘার দাদা সৌরভও বছর দু’য়েক আগে মাধ্যমিকে ৯০ শতাংশ নম্বর পায়। পদ্মার পড়াশোনায় সবসময় সাহায্য করেছেন সন্তোষবাবুর বন্ধু সদানন্দ আচার্য, বিশ্বজিৎ সিংহ। বীজপুর নেতাজি শিক্ষানিকেতনের ছাত্রী পদ্মা জানায়, কখনও মন খারাপ হলে উৎসাহ জুগিয়েছেন শিক্ষিক অনিন্দিতা দাস, বিকাশ চন্দ্রেরা। তবে মাধ্যমিকের বেড়া টপকালেও এ বার কী হবে তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন বলে জানান সন্তোষবাবু।

এর মধ্যে দিনে দিনে রোজগার কমছে বলে দাবি সন্তোষবাবুর। তাঁর কথায়, ‘‘একের পর এক কোলিয়ারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জৌলুস কমেছে এলাকার। পাল্লা দিয়ে কমেছে রোজগার।’’ পদ্মার মা কবিতাদেবী জানান, ছেলে চায় চিকিৎসক হতে। দাদার স্বপ্নপূরণে এখনও পদ্মা নিজের ইচ্ছেটা মুখ ফুটে বাবার কাছে বলতে পারেনি। তবে মেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বে বলেই জানান সন্তোষবাবু। রানিগঞ্জের অঙ্কের শিক্ষক বাসুদেব গোস্বামী ইতিমধ্যেই পাশে দাঁড়িয়েছেন। সন্তোষবাবুর ভরসা, হয়তো বাসুদেববাবুদের মতো মানুষদের সাহায্যেই ছেলে, মেয়ে দু’জনেই এগিয়ে যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

madhyamik student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE