পানুহাটে মিছিল। নিজস্ব চিত্র
বালাকোট-কান্ডের পরে বিজেপি যুব মোর্চার নেতৃত্বে পতাকা, স্লোগানবিহীন বিশাল মিছিলের ছাপ পড়েছিল মানুষের মনে। ভোটের ঠিক আগে কাটোয়া স্টেশন লাগোয়া একটি টোটো স্ট্যান্ডের সামনে চালকদের বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘ভোটটা বিজেপির বাক্সেই পড়বে’।
তারও আগে পঞ্চায়েত ভোটের সময় কাটোয়া শহরের বিভিন্ন মোড়ে দুষ্কৃতীদের লাগামছাড়া দাপাদাপি দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল ব্যবসায়ী মহল। ২০১৫ সালের পুরভোটের স্মৃতিও ফিরে এসেছিল তাঁদের মনে। লোকসভা ভোটের আগে এক ব্যবসায়ী বলেছিলেন, “উপরে শান্তি থাকলেও, ভিতরে একটা আতঙ্ক রয়ে গিয়েছে। তৃণমূল বিরোধীরা বিজেপিকেই বেছে নিয়েছেন।’’
এ বারের লোকসভা ভোটের ফলে বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্রে জিতেছে তৃণমূল। সাতটি বিধানসভার মধ্যে একমাত্র কাটোয়ায় তৃণমূল হেরেছে বিজেপির কাছে। ২০১৬ সালে যেখানে তৃণমূল ৯৫৯ ভোটে জিতেছিল, এ বার সেই বিধানসভাতেই বিজেপি জিতেছে ১ হাজার ৮৫৯ (পোস্টাল ব্যালট ছাড়া) ভোটে। জয়ের পরেই প্রার্থী সুনীল মণ্ডল দাবি করেছেন, ‘‘কাটোয়া নিয়ে আলোচনায় বসার দরকার রয়েছে।’’ বিজেপি নেতাদের দাবি, কাটোয়ার তৃণমূল নেতাদের একজোট হয়ে মাঠে না নামা, তার সঙ্গে দীর্ঘদিন অচলাবস্থার পরে অনাস্থা এনে পুরসভা দখল ও দুর্নীতির একাধিক অভিযোগই তাঁদের পক্ষে এসেছে। তৃণমূল নেতারা প্রকাশ্যে অবশ্য ধর্মীয় মেরুকরণকে পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ বলে দাবি করেছেন।
রামনবমীর মিছিলে বিশাল জমায়েত দেখেছিল কাটোয়া। বিজেপি ‘বাড়ছে’ বুঝতে পারার পরেও দলের নেতারা ব্যস্ত ছিলেন পরস্পরের দিকে আঙুল তুলতে, দাবি তৃণমূলেরই নিচুতলার কর্মীদের। বিধায়ক তথা পুরপ্রধান রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোট প্রচার করলেও তত দিনে আরএসএস কাটোয়া শহরে একটি শাখা থেকে ১৫টি শাখা গড়ে তুলেছে। আর বিধানসভা এলাকায় তাদের প্রায় ৪০টি শাখা কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। বিজেপির সাংগঠনিক জেলার (কাটোয়া) কর্মসমিতির সদস্য অনিল দত্ত বলেন, “আরএসএস তার কাজ করেছে। পরোক্ষ প্রচার যে আমাদের কাজে লেগেছে, তা অস্বীকার করব কেন!’’
এই বিধানসভার ভিতরেই কাটোয়া শহর। ২০১৬-য় বাম-কংগ্রেস জোটের কাছে তৃণমূল হেরেছিল সাড়ে ৪ হাজার ভোটে। আর এ বার বিজেপি এগিয়ে ৮ হাজার ৭০৫ ভোটে। অর্থাৎ বিধানসভার চেয়ে ভোট কমেছে তৃণমূলের। বছর খানেক আগে সিপিএমের হাত থেকে দাঁইহাট শহর তৃণমূল ছিনিয়ে নিয়েছিল। এ বার দাঁইহাটেও বিজেপি প্রায় ২৯০০ ভোটে এগিয়ে। রবীন্দ্রনাথবাবুর দাবি, “মেরুকরণের রাজনীতি, সংগঠিত ভাবে সিপিএমের ভোট বিজেপি চলে যাওয়া এবং দলের মধ্যে বিরোধিতার জন্যেই এই ফল বলে মনে হচ্ছে।’’ কাটোয়ার শহরের কুড়িটি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪টিতেই বিজেপি এগিয়ে। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে দাঁড়িয়েছিলেন রবিবাবু। সেখানে ৬০৮ ভোটে পিছিয়ে তৃণমূল। ওখানকার দলের যুব নেতা অরিন্দম বন্দোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘পুরপ্রধানের সঙ্গে সাধারণ মানুষদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পরেও দল কেন পিছিয়ে পড়ল তার জবাব ওঁর দেওয়া উচিত।’’ দাঁইহাট পুরসভাতেও ১৪টির মধ্যে মাত্র ৫টি ওয়ার্ডে ‘লিড’ দিয়েছে তৃণমূল। পুরপ্রধান শিশির মণ্ডলের দাবি, ‘‘বিজেপির পতাকা টাঙানোর লোক নেই দাঁইহাটে। তবুও ৯টা ওয়ার্ডে লিড দিল মেরুকরণের জন্যই।’ তৃণমূলের কাটোয়া শহর সভাপতি অমর রামও পুরসভায় দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তাঁর দাবি, “পুরপ্রধানের মদতে পানুহাট-সহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের অত্যাচার হয়েছে। সবাইকে নিয়ে চলতে না পারার যে পরিণাম হওয়ার কথা, সেটাই হয়েছে।’’
বিজেপির ওই সাংগঠনিক জেলার সভাপতি কৃষ্ণ ঘোষের দাবি, “২০১৫ সালে গুলি-বোমা দেখেছিল কাটোয়া শহর। কংগ্রেস থেকে রবীন্দ্রনাথবাবুর তৃণমূলে যাওয়াটা শহরবাসী এখনও মানতে পারেননি। তেমনি দাঁইহাট পুরসভাও জোর করে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও মানুষ ভালভাবে নেয়নি। সে জন্যেই তৃণমূল-বিরোধী ভোট এককাট্টা হয়ে আমাদের বাক্সে পড়েছে।’’ অনিলবাবুও বলেন, “পুরসভার কাজকর্ম মানুষ পছন্দ করছে না। কাউন্সিলরদের দুর্নীতি মানুষ ধরে ফেলছেন। বিকল্প হিসেবে মানুষ আমাদের বেছে নিয়েছে।’’ সঙ্গে পঞ্চায়েতে মহকুমা জুড়ে ভোট না হওয়ার ‘ক্ষোভ’, কাটোয়া রেলগেটে উড়ালপুল, স্টেডিয়াম সংস্কারের মতো কাজও না হওয়ায় বিপক্ষে গিয়েছে বলে তাঁদের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy