Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নদীর পাড়েই চোলাই-শিল্প

কারবার বহু দিনের। ভোটের মরসুমে নির্বাচন কমিশনের গুঁতোয় দিন কয়েকের বিরতি ছিল। তবে ভাতারের বসতপুরে চোলাই ব্যবসার রমরমা যে বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই, শুক্রবারের ঘটনা থেকেই তা পরিষ্কার।

শুক্রবার ভাঙচুরের পরে আবগারি দফতর।—নিজস্ব চিত্র।

শুক্রবার ভাঙচুরের পরে আবগারি দফতর।—নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
ভাতার শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০২:২৪
Share: Save:

কারবার বহু দিনের। ভোটের মরসুমে নির্বাচন কমিশনের গুঁতোয় দিন কয়েকের বিরতি ছিল। তবে ভাতারের বসতপুরে চোলাই ব্যবসার রমরমা যে বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই, শুক্রবারের ঘটনা থেকেই তা পরিষ্কার।

শুক্রবার সকালে আবগারি দফতর থেকে বন্দি ছিনতাই, সেখানকার কর্মীদের মারধর ও তাণ্ডবের পরে মাহাতা পঞ্চায়েতের বসতপুরে চোলাই কারবারে মদত দেওয়ার পিছনে শাসক দলের নাম জড়িয়েছে। যদিও চোলাই-ব্যবসাকে মদত দেওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই বলে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা দাবি করেছেন। তাঁদের পাল্টা অভিযোগ, নতুন করে চোলাই তৈরিতে উৎসাহ দিচ্ছে বিরোধীরা।

আউশগ্রাম, ভাতার ও মঙ্গলকোটের সীমান্তবর্তী গ্রাম বসতপুর। স্থানীয় সূত্রের খবর, এই গ্রামে চোলাইয়ের কারবার দীর্ঘ দিনের। গ্রামের এক দিকে সেচখাল, অন্য দিকে বয়ে গিয়েছে কুনুর নদী। এই খাল ও নদীর ধারেই রমরমিয়ে চোলাই তৈরি হয়। বসতপুর ছাড়াও এই এলাকার আশপাশে বেশ কয়েকটি গ্রামে এই কারবার হয়। কিন্তু চোলাই তৈরির দৌলতে বসতপুরের মতো পরিচিত তাদের নেই। আবগারি দফতরের কর্তারা জানান, ২০১১-র ডিসেম্বরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সংগ্রামপুরে চোলাই খেয়ে ১৭৩ জনের মৃত্যুর পরে রাজ্য জুড়ে আবগারি দফতর ও পুলিশ চোলাইয়ের ভাটি ও ঠেক বন্ধে উদ্যোগী হয়। সেই সময়েও বসতপুরে গোপনে চোলাই-কারবার চালু ছিল বলে এলাকা সূত্রে জানা যায়। তার পরে বেশ কয়েক বার অভিযান হলেও বসতপুরে চোলাইয়ের রমরমা বন্ধ করতে পারেনি পুলিশ। এ বার বিধানসভা ভোটের আগে কমিশনের নির্দেশে রাজ্য জুড়ে চোলাইয়ের ঠেক ও ভাটি বন্ধ করা হয়। নামপ্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় কয়েক জন বাসিন্দা জানান, ভোটের সময়েও লুকিয়ে-চুরিয়ে চোলাই তৈরি হয়েছে। ভোট মিটতে ফের তা প্রকাশ্যে এসেছে। সে জন্যই আবগারি দফতরের রাজ্য স্তরের কর্তাদের বসতপুরে চোলাই কারবার বন্ধের জন্য মাথা ঘামাতে হয়েছে।

শুক্রবার সকালে কাটোয়া, কালনা, আউশগ্রাম ও ভাতার থানার ২৫ জন কর্মী বসতপুরে যান। হাতেনাতে দু’জনকে ধরা হয়। বাজেয়াপ্ত করা হয় প্রায় ২০০ লিটার চোলাই, তৈরির উপকরণ ও জ্যারিকেন ঝোলানো তিনটি মোটরবাইক। অভিযানে বাধা দেওয়ায় আবগারি দফতরের লোকজনের সঙ্গে বচসা হয় গ্রামের মহিলাদের। তবে সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে সকাল ৮টার মধ্যে ধৃতদের নিয়ে গুসকরা অফিসে পৌঁছে যান আবগারি দফতরের কর্মীরা। খানিক পরেই তিনটি ছোট মালবাহী গাড়িতে প্রায় ৫০-৬০ জন হাজির হয় সেখানে। অভিযোগ, তাদের নেতৃত্বে ছিলেন মাহাতা পঞ্চায়েতের প্রধানের ছেলে সুমন্ত মাঝি। দফতরে ঢুকে চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর, ধস্তাধস্তি করে হামলাকারীরা। বাধা দিতে গিয়ে আহত হন আবগারি দফতরের ওসি ধ্রুবজ্যোতি অধিকারী-সহ সাত জন। পুলিশ গিয়ে লাঠি চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করলেও ধৃত চোলাই কারবারিরা পালিয়ে যায়। এই ঘটনায় এক মহিলা সহ ৬ জনকে গ্রেফতার করলেও সুমন্ত অধরা। পুলিশ জানায়, তার খোঁজ চলছে।

আবগারি দফতর ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বসতপুরে প্রায় ৭০টি পরিবার চোলাই কারবারে যুক্ত রয়েছে। রাতে নদী ও সেচখালের ধারে চোলাই তৈরি হয়। এই নদীর পাড়ই যেন চোলাইয়ের কারখানা। ভোরে বাড়ি-বাড়ি থেকে বড় জ্যারিকেনে চোলাই সরবরাহ করা হয়। বিকেলে বড়-বড় ব্লাডারে করে বাসে চোলাই পাচার হয় কাটোয়া শহরে। মোটরবাইকে করে চোলাই যায় বর্ধমান, গুসকরা, বোলপুর ও আউশগ্রাম হয়ে ইলামবাজার পর্যন্ত। সে জন্য বসতপুরে ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত মোটরবাইকে দৌরাত্ম্য দেখা যায়।

গুসকরার বাসিন্দা, এক মানবাধিকার সংস্থার কর্তা তপন মাজি বলেন, “ওই এলাকার চোলাই কারবারিদের নাম দিয়ে জেলাশাসকের কাছে কয়েক বছর আগে বিশদ অভিযোগ করেছিলাম। পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আমরা চোলাই বন্ধে অভিযানও চালিয়েছিলাম। কিন্তু সবটাই সাময়িক। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এই কারবার বন্ধ করা অসম্ভব।” জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, তারাও বেশ কয়েক বার অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু বসতপুরে এক বার মোরাম রাস্তা কেটে দেয় চোলাই কারবারিরা। তা ছাড়া গাড়ি দেখলেই তারা পালিয়ে যায়।

রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন আরও বেশি করে উঠছে শুক্রবারের ঘটনায় তৃণমূলের নাম জড়ানোয়। সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য বামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চোলাই কারবারিদের কারা মদত দেয়, শুক্রবারের ঘটনার পরে তা স্পষ্ট।” সিপিএমের আরও অভিযোগ, স্থানীয় এক পঞ্চায়েত সদস্যের পরিবার সরাসরি চোলাই কারবারে যুক্ত।

তৃণমূল অবশ্য এ সব অভিযোগ মানতে নারাজ। শুক্রবারের ঘটনায় অভিযুক্ত সুমন্তর বাবা তথা ওই পঞ্চায়েতেরই উপপ্রধান নিখিলেশ্বর মাঝি দাবি করেন, ‘‘ওই ঘটনায় আমার ছেলে ছিল না। সে আমার সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিল শপথ অনুষ্ঠান দেখতে।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘মদত তো দূরের কথা, আমার নেতৃত্বেই প্রথম চোলাই বিরোধী অভিযান হয়। এ বারও অভিযানের ব্যাপারে উদ্যোগী হব।’’ ভাতারের নতুন তৃণমূল বিধায়ক সুভাষ মণ্ডল বলেন, “স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব চোলাই কারবারিদের মদত দিচ্ছে বলে বিশ্বাস করি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hooch den Liquor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE