বিঘার পর বিঘা জমিতে সবুজ গাছে ফুটে রয়েছে সাদা বা হালকা গোলাপি ফুল। অন্ডাল-রানিগঞ্জ এলাকায় বছরের নানা সময়ে চোখে পড়ে এই ছবি। খনি অঞ্চলে পোস্ত চাষের এই রমরমা বন্ধে অভিযান হয় মাঝে-মধ্যে। কিন্তু পাকাপাকি ভাবে এই বেআইনি কারবার বন্ধ হচ্ছে না। বরং, বছর-বছর এই কারবার ফুলেফেঁপে উঠছে বলে এলাকাবাসীর দাবি। যার জেরে নেশার প্রকোপ, মাফিয়া দৌরাত্ম্যও বাড়ছে বলে অভিযোগ তাঁদের।
আবগারি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জামুড়িয়া, পাণ্ডবেশ্বর-সহ কিছু এলাকায় অজয়ের চরে পোস্ত চাষ করছে কিছু দুষ্কৃতী। খেত দেখে মনে হয় ফুলের বাগান। দফতরের কর্তারা জানান, জামুড়িয়ার লালবাজার, বীরকুলটি, বাড়ুল, দরবারডাঙা, প্রেমবাজার, সাকড়ি, কুমারডিহি, পাণ্ডবেশ্বরের রামনগর গ্রাম লাগোয়া অজয়ের চর, গোবিন্দপুর, ফড়কড়ি-সহ বেশ কিছু অঞ্চলে নিয়মিত পোস্ত চাষ হয়। আবগারি দফতরের বর্ধমান পশ্চিম বিভাগের সুপার সুদীপ সান্যাল জানান, এই এলাকার মাটি ও আবহাওয়া পোস্ত চাষের উপযোগী। ফলন তাই ভাল হয়। সে জন্য এই অঞ্চলকে বেছে নিয়েছে মাফিয়ারা।
সুদীপবাবু জানান, কেন্দ্রের ১৯৮৫ সালের ‘নারকোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস’ আইনে পোস্ত চাষকে অবৈধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এই চাষে যুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে ১০-২০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে। যে জমিতে পোস্ত চাষ করা হবে সেই জমির মালিককেও ওই একই সাজা ভুগতে হবে। সুদীপবাবু বলেন, ‘‘পোস্তর খোল থেকে আফিম পাওয়া যায়। যা নেশার দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার হয়। তাই এই চাষ বন্ধের আইন রয়েছে।’’
কিন্তু আইন থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলে পোস্ত চাষ বন্ধ করা যাচ্ছে না। আবগারি দফতরের আধিকারিকদের দাবি, দুষ্কৃতীরা সব সময় খাস জমিতে পোস্ত চাষ করে। তাই দফতর অভিযান চালিয়ে পোস্ত গাছ নষ্ট করলেও যারা চাষ করছে তাদের নাগাল মেলে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপও করা যায় না। সুদীপবাবুর মতে, ‘‘এই চাষ একেবারে বন্ধ করতে হলে সরকারি খাস জমিগুলি নজরে রাখতে হবে, যাতে সেখানে কোনও ভাবে দুষ্কৃতীরা চাষ করতে না পারে।’’ তিনি জানান, এলাকার মানুষজনের পাশাপাশি ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর এবং ব্লক প্রশাসনের কাছে আবেদন করা হয়েছে, পোস্তর বীজ কেউ বুনলেই যেন খবর দেওয়া হয়।
পোস্ত চাষের সময়ে এলাকায় গেলে দেখা যায়, ছোট বলের আকারের পরিণত পোস্ত ফলের খোল থেকে এক দল লোক আফিম সংগ্রহ করছেন। ব্লেড দিয়ে ওই বলের চারপাশে চিরে দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে অল্প পরিমানে এক ধরনের আঠা বেরোচ্ছে। ওই আঠাই আফিম, জানালেন কাজে নিযুক্ত লোকজন। জমিতে ফলে থাকা পোস্তর খোল থেকে আঠা বের করতে কাঠা প্রতি জমির জন্য সাত-দশ হাজার টাকা পর্যন্ত দেন বলে ওই সব লোকজনের দাবি। আবগারি আধিকারিক সুদীপবাবু জানান, পোস্ত ও খোলের আঠা বিক্রি করে প্রচুর লাভ হয় বলেই ঝুঁকি নিয়ে এক দল মাফিয়া এই চাষ করে।
আসানসোল মহকুমা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক তন্ময় রায় বলেন, ‘‘খাস জমি দেখভালের দায়িত্ব আমাদের। সেখানে পোস্ত চাষ রোখার ব্যাপারে আমরা যথাসম্ভব নজর রাখি।’’ যদিও ওই দফতরের এক আধিকারিকের দাবি, কর্মী এত কম যে সব সময় ঠিক ভাবে নজর রাখা সম্ভব হয় না। পাণ্ডবেশ্বরের বিডিও সুবল মহাপাত্র বলেন, ‘‘মাঝে আমরা অজয়ের চরে বেশ কিছু পোস্ত গাছ নষ্ট করেছি। আবগারি দফতর সাহায্য চাইলেই আমরা সহযোগিতা করি।’’ জামুড়িয়ার বিডিও বুদ্ধদেব পানেরও বক্তব্য, ‘‘সীমিত কর্মী দিয়ে এলাকায় নজর রাখি। প্রচারও করি। তবু এক দল দুষ্কৃতী এই কাজ করে চলেছে।’’
পোস্ত চাষে তাই পুরোপুরি রাশ টানা যাবে কী ভাবে, জানা নেই কারও।