Advertisement
১৮ মে ২০২৪

রাজনীতির ছকেই কি খুন সেলিম

তিন দশক ধরে এলাকা জুড়ে নানা দুষ্কর্মের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সব সময়েই তিনি শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে অভিযোগ করত বিরোধীরা।

সুব্রত সীট
দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৬ ০২:১৫
Share: Save:

• ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর লাউদোহার মাধাইগঞ্জে বাড়ির সামনেই খুন শেখ সেলিম।

• দু’টি মোটরবাইকে চড়ে আসা চার জন দুষ্কৃতী সামনে থেকে পরপর গুলি করে পালিয়ে যায়।

• গ্রেফতার হয় মোট সাত জন। সকলেই জামিনে মুক্ত।

• দুর্গাপুর আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগ। মামলা বিচারাধীন।

তিন দশক ধরে এলাকা জুড়ে নানা দুষ্কর্মের অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। সব সময়েই তিনি শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে অভিযোগ করত বিরোধীরা। বাম আমলে সিপিএমের সভা-সমিতিতে, আবার রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদলের পরে পরে তৃণমূলের নানা কর্মসূচিতে দেখা যেত শেখ সেলিমকে।

২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর এক বিকেলে লাউদোহার মাধাইগঞ্জে বাড়ি ফিরছিলেন সেলিম। বাড়ির কাছেই নিজের পেট্রোল পাম্পে মোটরবাইকটি রেখে হেঁটে বাড়ির দিকে এগোচ্ছিলেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, সেই সময়ে কয়েক জন দুষ্কৃতী মোটরবাইকে চড়ে আসে। সেলিমের একেবারে সামনে এসে পরপর গুলি করে তারা। তার পরে চম্পট দেয়। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে লুটিয়ে পড়েন সেলিম। তাঁকে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সেলিমের আসল বাড়ি ছিল কৈলাসপুরে। ইসিএলের অনেক কর্মী সংস্থা থেকে পারিবারিক প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য পাওয়া কয়লা বিক্রি করে দিতেন। কম বয়সে সেই কয়লা অল্প দামে কিনে অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে কারবারে হাতেখড়ি সেলিমের। অভিযোগ, তার পরে পাণ্ডবেশ্বর ও লাউদোহার নানা খনি থেকে কয়লা বের করে আনা শুরু করেন তিনি। অবৈধ কয়লা কারবার ছাড়াও খুন, জখম, বোমাবাজির নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করে তাঁর বিরুদ্ধে। জেলও খাটতে হয়েছে অনেক দিন। এরই মধ্যে কৈলাসপুর ছেড়ে তিনি উঠে আসেন মাধাইগঞ্জে। বড় বাড়ি, গাড়ি, কাঠগোলা, পেট্রোল পাম্প তৈরি করে ফেলেন।

এই সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ফাঁকেই এলাকায় সেলিমের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসে তাঁর এক সময়ের সঙ্গী শেখ আমিন। এলাকা দখল নিয়ে তাদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মাঝে-মাঝেই গুলি-বোমার লড়াই বেধে যেত। ২০০৮-এর জুনে এক সকালে কৈলাসপুর থেকে মাধাইগঞ্জ যাওয়ার সময়ে সেলিমের গাড়ি লক্ষ করেও এক বার গুলি-বোমা ছোড়া হয়।

স্থানীয় নানা সূত্রের দাবি, সেই সময়ে সিপিএমের নানা সভায় সেলিমকে দেখা যেত। সিপিএম নেতারা যদিও কখনও তা মানতে চাননি। বরং, ২০০৮ সালের জুলাইয়ে সিপিএমের লাউদোহা লোকাল কমিটির সদস্য ফারুক ও তাঁর এক সঙ্গীকে খুনের অভিযোগ ওঠে সেলিমের বিরুদ্ধে। ফারুক এলাকায় দুষ্কৃতী-দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। মাস পাঁচেক ফেরার থাকার পরে গ্রেফতার হয় সে। দীর্ঘ দিন জেলে থাকার পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে এসে সেলিম নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন বলে স্থানীয় সূত্রের খবর। যদিও রাজ্যে তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তাঁর সঙ্গে শাসকদলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল। স্থানীয় একটি স্কুলের ভোটে তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে তাঁকে দেখাও গিয়েছিল।

সেলিম খুন হওয়ার পরেই তৃণমূলের কয়েক জন নেতাকে হাসপাতালে ছুটে যেতে দেখা গিয়েছিল। তাঁরা অভিযোগ করেছিলেন, ঘটনার পিছনে হাত রয়েছে সিপিএমের। সিপিএম যদিও পাল্টা দাবি করে, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই এই খুন বলে তাদের ধারণা। পুলিশি তদন্তেও উঠে এসেছিল অন্য নানা তথ্য। বাড়ি ও পেট্রোল পাম্পের সিসি ক্যামেরার ছবি পরীক্ষা করে পুলিশ দেখে, বিকেল ৪টে নাগাদ পাম্পে গাড়ি রেখে সেলিম বাড়ি যাচ্ছিলেন। তখন দু’টি মোটরবাইকে চার জন আসে। এক দুষ্কৃতী মোটরবাইকে বসেই কার্বাইন থেকে গুলি ছোড়ে। নাইন এমএম পিস্তল থেকে গুলি ছোড়ে অন্য মোটরবাইকের এক সওয়ার। পিস্তল কাজ করেনি। খোল-সহ গুলি পড়ে যায়। তবে কার্বাইনের সব গুলি বেরিয়ে যায়। কয়েকটি লাগে সেলিমের গায়ে। এক দিন পরেই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সেলিমের আদি বাড়ি কৈলাসপুর থেকে দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। দিন দুয়েকের মধ্যে কাঁকসার মলানদিঘির জঙ্গল থেকে ধরা হয় আরও দু’জনকে। তাদের জেরা করে ধরা পড়ে আরও দু’জন। ধৃতেরা সবাই আমিন-গোষ্ঠীর লোক হিসেবে পরিচিত।

ধৃতদের জেরা করে পুলিশ দুর্জয় বিশ্বাস নামে লাউদোহার নতুনডাঙার এক বাসিন্দার নাম পায়। তিনি নিজেকে এলাকায় তৃণমূলের সেবাদলের নেতা বলে পরিচয় দিতেন। পুলিশের দাবি, জেরায় ধৃতেরা জানায়, দুর্জয় পিস্তল কেনার জন্য তাদের টাকা দিয়েছিল। পরে পুলিশ-প্রশাসনের উপরে প্রভাব খাটিয়ে পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিল। এ সব কথা প্রকাশ্যে আসার পরে তৃণমূল অবশ্য জানায়, তাদের কোনও সেবাদল নেই। তাই ওই ব্যক্তি তাদের দলের কেউ নয়। পুলিশ দাবি করেছিল, তদন্তে জানা গিয়েছে, সেলিমের সঙ্গে তৃণমূলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় দুর্জয় সেলিমের প্রতিদ্বন্দ্বী শেখ আমিনের দলবলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান। সে জন্য সেলিম তাঁকে সতর্ক করেন। বেগতিক বুঝে আমিন-শিবিরের সঙ্গে দুর্জয় সেলিমকে খুনের চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্তেরা সবাই গ্রেফতার হয়েছিল। তবে পরে তারা সকলেই জামিন পেয়ে যায়। আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগ আদালতে চার্জশিট জমা দেয়। ইতিমধ্যে গোটা বিষয়টি থেকে তৃণমূল দূরত্ব তৈরি করেছে। নিহতের পরিবারের দাবি, মামলা নিয়ে তদ্বির করার মতো কেউ নেই। সেলিমের বড় মেয়ে আমিনা বিবির কথায়, ‘‘আমরা এখনও বিচার পেলাম না।’’ কয়লা কারবার না রাজনীতি— কীসের অঙ্কে খুন করা হল সেলিমকে, ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে সে নিয়েও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

politics murder crime police file
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE