Advertisement
E-Paper

নবান্নের টানে আর কত দিন...

উন্মাদনার এই ঐতিহ্যটা তো আর সাধে গড়ে ওঠেনি! এর পিছনে যথাযোগ্য আর্থসামাজিক, ঐতিহাসিক কারণও আছে। স্বল্প ফলনের, দেশি জাতের, এক ফসলি ধান তখন ‘সোনার দানা’। খুব কদরের, খুব আদরের।

তপোময় ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০২:৩৯
ধান ওঠার পালা। ফাইল ছবি

ধান ওঠার পালা। ফাইল ছবি

বর্ধমানে একাধিক নবগ্রাম আছে এবং সবগুলিরই স্থানীয় নাম ‘ল’ গাঁ। কেতুগ্রাম ২ ব্লকেও একটি পঞ্চায়েতের নাম নবগ্রাম। এই নবান্ন প্রসঙ্গে এই ‘ল’ গ্রামের অনুষঙ্গে, বলা ভাল ‘ল’-এর অনুপ্রাসে সুন্দর একটি বাক্যবন্ধ আছে—‘ল’ গাঁয়ের ল’গিন্নি লাউ লিয়ে লদীর লালা পেরোতে পেরোতে বলল, ল’য়ই লবাল্ল, লা করলে লয়।’

এই হল ‘ল’ (নয়) তারিখে ‘নবান্ন’র দিন ধার্য হওয়ার কথা। গ্রামের গণ্যমান্যরাই এখনও এই দিন ধার্য করে দেন। তবে, আগের মতো গুরু-পুরোহিতদের কথায় নয়, ছেলেপিলেদের ছুটিছাটা দেখে বা নিতান্ত রবিবারে নবান্ন হয়। এ বছরেও ৯ অগ্রহায়ণ জেলার শত শত গ্রামে নবান্ন উৎসব হয়ে গেল। এটা ঘটনা যে, ‘নবান্ন’ শব্দটি উচ্চারিত হলে এখনও সারা বছরের নিস্তরঙ্গ গ্রামে যেন একটা প্রাণকোলাহল জেগে ওঠে। গ্রামবাসী তো বটেই, বাইরে কাজের জন্য যাওয়া মানুষেরাও ছুটে আসে নবান্নের টানে।

উন্মাদনার এই ঐতিহ্যটা তো আর সাধে গড়ে ওঠেনি! এর পিছনে যথাযোগ্য আর্থসামাজিক, ঐতিহাসিক কারণও আছে। স্বল্প ফলনের, দেশি জাতের, এক ফসলি ধান তখন ‘সোনার দানা’। খুব কদরের, খুব আদরের। হবে না-ই বা কেন, গত বছরের ধান তো আগেই ফুরিয়েছে। রামের বেটা গোলা ঝেড়ে সে ধান নামিয়েছে আষাঢ়ে, শ্যামের বউ ঘরের ধানের চালে শেষ ভাত রেঁধেছে শাওনের বাদলা আর চোখের জলে ভিজে। গাঁয়ের সব চাষাভুষো মানুষগুলোর তাই হা পিত্যেশ নতুন ধানের জন্য, ‘নবান্ন’র জন্য। এই বাংলার নবান্ন তাই বিশ্বজোড়া ক্ষুধার প্রেক্ষিতে এক ঐতিহাসিক ‘ধান্য উৎসব’।

দিনকাল বদলেছে। এখন আর দুর্ভিক্ষ নেই গ্রামবাংলায়। তিন বার ধান উঠছে, ধান যেন হারিয়েছে তার পুরনো গৌরব। নব্য যুবক-যুবতীরা এখন আর ধানকে ‘লক্ষ্মী’র মর্যাদা দেয় না। তবু যেন নবান্ন-র একটা আবহ অঘ্রানের গাঁয়ে রয়ে গিয়েছে।

বিগত সেই সব অভাবের দিনেও কার্তিক সংক্রান্তি না পেরোলে নতুন ধানের গোড়ায় কাস্তের পোঁচ দেওয়া যেত না। ‘মুধ সংক্রান্তি’তে আড়াই ঝাড় ধান কেটে, তাকে পুজো করে তবে নতুন ধান কাটা হতো। তার পরে সেই ধান শুকিয়ে বাড়ি এনে চাল করে তবে নবান্ন। তার আগে অবশ্য বর্ষার আগাছা জন্মানো খামার পরিষ্কার করে, গোবর-মাটি দিয়ে নিকিয়ে তবে সেখানে ধান তোলা। ধামা-কুলো-ভালা এমনকী ঢেঁকি, ঢেঁকিশালের আনাচকানাচ ধোয়া মোছা। সেই অতীতে শুদ্ধতার বাড়াবাড়ি এত দূর ছিল যে, গেরস্থ বাড়িতে ধান ভানত যে বধূটি, তাঁকেও অঘ্রানের শিরশিরে ভোরে স্নান সেরে তবে ঢেঁকিতে উঠতে হতো। এখন অবশ্য ‘হাস্কিং মেশিনে’র মালিক গণ্ডুষ পরিমাণ গঙ্গাজল ছিটিয়ে কাজ সারছেন। গোটা গাঁয়ের সবার আতপ চাল তো তাঁকেই ভাঙিয়ে দিতে হচ্ছে।

তবে, শুধু চাল দিয়ে নবান্ন হয় না কি? খামারের কোণে যত্নে লাগানো পালং শাকের কচি পাতা, সেই ভাদর মাস থেকে আগলে রাখা কলার কাঁদিটা, যে জমির আখ এখনও কাটা হয়নি, সেই আখ লাগে না বুঝি? আখ, গাছের নারকেল কুচি কুচি করে কেটে মেশানো হয় নতুন চালের গুঁড়োতে। মিশবে ধবল গাভীর গাঢ় দুধের ক্ষীর। সে সবের আয়োজনে ব্যস্ত থাকে বাড়ির পুরুষ সদস্যেরা। কেউ বাগানে কলাপাতা কাটে তো কেউ যায় পুকুরে মাছ ধরতে। প্রবীণ গিন্নিমা পুরনো গরদের শাড়িটা পড়ে দুব্বো তুলে আনে। সঙ্গে, ভিজে চুলের ছোট্ট নাতনি। বাড়ির বউমারা ব্যস্ত রান্নাঘরে, ঘরের রাই-সর্ষে ভাঙানো তেলে ভাজাভুজি চলছে ‘ভাত নবান্নে’র জন্য।

প্রচলিত ধর্মাচার, লোকাচার মেনে বাড়ির গৃহকর্তা, পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে নিবেদন করছেন বছরের নতুন অন্ন। শুকনো চাল ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাড়ির সামনের নিকানো উঠানে। চরাচরের পাখপাখালির জন্য। তার পরে বংশের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম জানিয়ে আত্মীয় পরিজনদের নিয়ে নতুন চালের নবান্ন গ্রহণের তৃপ্তি।

নবান্নের এই পরিচিত দৃশ্য দ্রুত বিরল হয়ে যাচ্ছে। কারণ, বঙ্গের অর্থনীতিতে ধান-চাল তার কৌলিন্য হারিয়েছে। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, পাশের গ্রামে যাওয়ার জন্য নদী পেরনোর নৌকার মাঝি, আমাদের শু‌ভ কাকা নবান্নের দিনে সারা বছরের ‘পারানি’ বাবদ চাল-কলা নিয়ে যেতেন। নাপিত-পুরুত-কামার-কুমোর সবাই সারা বছরের পাওনা নিয়ে যেতেন। কার্তিক জুড়ে গ্রাম ঘুরে ভৈরবী সুরে টহল দিত যে বৈরাগী, সেও ওই দিন এসে ঝুলি ভরে নিয়ে যেত গেরস্তের সুরের প্রতিদান।

এই নবান্নে তাই ধান কাটা হতো আনন্দে। এই নবান্নেই মিটত বহু দিনের পুরনো ইচ্ছা। আর যারা খেতমজুর, শুধুই গায়েগতরে খেটে সংসার চালায়, তারা নবান্নের পরে পুরোদমে ধান কাটার কাজে লাগত। সেই মজুরির টাকায় তাদের সংসার চলত। উঠত নবান্নের খরচও। কিন্তু, এ বছর অনেকেরই সে কাজ আর থাকছে না। পালের ছেলেরা বলেছে, তিন মাঠে তিনটে ধান কাটার মেশিন নামাবে। সব মাঠের ধান তিন দিনে কেটে সাফ। যারা খেতের কাজ ছাড়া কিছু জানে না, যারা এখনও গ্রাম ছেড়ে যেতে পারেনি, তাদের কাছে এই মেশিন নবান্নের আনন্দে বিষাদ সুর।

নবান্ন তো আসলে ধান কাটার উৎসব। কিন্তু, সেই ধান চাষে বর্ধমানের মতো জেলাতেও সেই সুদিন আর নেই। রাইস মিল-কারখানা-চালগদি সব ধুঁকছে।

তবুও শান্ত-স্নিগ্ধ-হৈমন্তিক নবান্নের পরম্পরা হয় তো থাকবে আরও কিছু কাল। নাগরিক জীবনের স্বাদ পাওয়া নতুন প্রজন্ম তাদের বাপ-ঠাকুরদার আম-কাঁঠালের ছায়া ঘেরা গ্রামে আরও কিছু কাল আসবে....না হয় এই নবান্নের টানেই।

লেখক কাটোয়া কলেজের শিক্ষক

Nabanna Utsav rural festival traditional festival
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy