Advertisement
০২ মে ২০২৪

অভাব বাধা নয়, চ্যালেঞ্জ তানিয়াদের কাছে

তখন সবে ক্লাস ওয়ান। ক্যানসারে ভুগে মারা গেলেন বাবা। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই। কেতুগ্রামের পালিটা হাইস্কুলের সেই ছাত্র দীপেন্দু পাল এ বার মাধ্যমিকে ৬২৬ নম্বর পেয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৮ ০২:৩৭
Share: Save:

অভাব তাদের হারাতে পারেনি। ভেঙে দিতে পারেনি তাদের মনোবল। বাস্তবের রুক্ষ জমিতে দাঁড়িয়ে তারা লড়াই করেছে। লড়াই করে সফলও হয়েছে। মাধ্যমিকে ভাল ফল করে মুখে হাসি ফুটিয়েছে দুঃস্থ পরিবারে। তবে তারা জানে, এই দৌড়ই শেষ নয়। তাই সামনের দিনে আরও বড় মাঠে দৌড়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে দীপেন্দু, তানিয়া, সুলতা, প্রেরণারা।

তখন সবে ক্লাস ওয়ান। ক্যানসারে ভুগে মারা গেলেন বাবা। তখন থেকেই শুরু হয়েছিল বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই। কেতুগ্রামের পালিটা হাইস্কুলের সেই ছাত্র দীপেন্দু পাল এ বার মাধ্যমিকে ৬২৬ নম্বর পেয়েছে। কিন্তু, সে জানে জীবনের পথে এটা প্রথম ধাপ পেরনো গেল। তাই লড়াইটা চালিয়ে যেতে চায় সে। কেতুগ্রামের বাঁশড়ার বাসিন্দা দীপেন্দুর বাবা মারা যান ১১ বছর আগে। মা আভা পাল পালিটা পঞ্চায়েতে মাসিক ১৫০০ টাকায় অস্থায়ী কর্মী হিসাবে কর আদায়ের কাজ করেন। এই টাকায় কোনও রকমে দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালান। এক কামরার ছোট্ট ঘর। সামান্য কিছু ভাগের জমি থাকলেও তা দেখাশোনা করার লোক নেই। স্কুলের শিক্ষকদের সহযোগিতায় দীপেন্দুর এই সাফল্য বলে জানালেন আভাদেবী। অঙ্ক ও ইংরেজির দু’জন গৃহশিক্ষক থাকলেও তাঁরা বিনা বেতনেই পড়া দেখিয়ে দিতেন দীপেন্দুকে। দীপেন্দুর কথায়, ‘‘পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ে শিক্ষক হতে চাই। তবে দু’বেলা ঠিক করে ভাতই জোটে না, পড়ব কী ভাবে!’’ প্রধান শিক্ষক কৃপাসিন্ধু দাস বলেন, ‘‘স্কুলে ওই প্রথম। সাধ্যমতো চেষ্টা করব ওকে সাহায্য করার।’’

এর পরে কী হবে, প্রশ্নটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে মেমারি ২ ব্লকের চকবলরামপুর কেপি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী তানিয়া সুলতানকেও। সে পেয়েছে ৬৫৮ নম্বর। তাঁদের বাড়ি কালনা ২ ব্লকের রসুলপুর গ্রামে। বাবা তাহের শেখ স্থানীয় একটি বেসরকারি স্কুলে বাস চালান। টালির চাল, দু-কামরার ছোট ঘরে দিন গুজরান। তানিয়ার মা নাসিরা বিবি দীর্ঘদিন ধরে নানা অসুখে ভুগছেন। তানিয়া বলে, “স্কুলের তিন জন শিক্ষক বিনা বেতনে আমাকে টেস্টের পরে পড়িয়েছিলেন। অন্য শিক্ষকেরাও অনেক সাহায্য করেছেন।’’ বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু, নিজেই বলছে, “পরিবারের আমাকে মেডিক্যালে পড়ানোর সামর্থ্য নেই।’’

ভাঙা বেড়া এবং টালির চালের একটি ঘর। বারন্দায় রান্না। চার জনের থাকা, খাওয়া। তার মধ্যেই ৬৪৯ নম্বর পেয়ে অনেককে চমকে দিয়েছে পারুলিয়া স্টেশন রোডের সুলতা বিশ্বাস। স্থানীয় কুলকামিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের এই ছাত্রীর পরিবারে নিদারুণ অর্থকষ্ট। পড়শিরা জানাচ্ছেন, মাত্র চার বছর আগে বিপিএল কোটায় সুলতাদের বাড়িতে পৌঁছয় বিদ্যুৎ। তার আগে সে লম্ফের আলোয় পড়াশোনা করত। বাবা হরিপদ বিশ্বাস রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। কাজ পেলে দিনে ২৫০ টাকা আয়। সুলতার মা গঙ্গা বিশ্বাসকে তাঁত শ্রমিকের কাজ করতে হয়। তিনি বলেন, ‘‘কাজ না হলে স্বামীর কোনও আয় নেই। তবু মেয়ের পড়ার জন্য দু’জন শিক্ষক রেখেছিলাম। তাতেই এমন ফল করেছে।’’ সুলতা বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে চায়। কিন্তু, জানে ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় ঘেরা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদীপ সাহা বলেন, ‘‘প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ওর এমন ফল আমাদেরও চমকে দিয়েছে। বই,খাতা-সহ ওই ছাত্রীকে স্কুল সাহায্য করবে।’’

ভাতার বাজারে একটি দোকানে সেলাইয়ের কাজ করতেন পম্পা কোনার। কয়েক মাস হল বাড়িতে মেশিন কিনে সেলাই করছেন। বরাত পাওয়া সেলাইয়ের কাজ করার সময়েই বুধবার খবর পেলেন তাঁর মেয়ে প্রেরণা মাধ্যমিকে ৬২২ পেয়েছে। আনন্দে কান্না ধরে রাখতে পারেননি ভাতার গার্লস হাইস্কুলের ছাত্রীর মা। বললেন, “গৃহশিক্ষক রেখেছিলাম। কিন্তু তাঁদের বেতন ঠিকমতো দিতে পারিনি। তাঁরা কোনও দিন বেতন চানওনি। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’’ প্রেরণার কথায়, “উচ্চমাধ্যমিক আর একটা চ্যালেঞ্জ। তার পরে কী হব, তখন ভাবা যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE