মঙ্গলবার সকালে এখানেই খুন হন শেখ আমিন (ইনসেটে)। ছবি: বিকাশ মশান।
এক সময়ের ডান হাত ক্রমে হয়ে দাঁড়ায় বিপক্ষ। অপরাধ জগতে যেন এটাই নিয়ম। ইদের সকালে লাউদোহায় শেখ আমিনকে খুনের ঘটনার পিছনে উঠে এসেছে সেই কাহিনিই। আমিনকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ায় মূল অভিযুক্ত যে, সেই শেখ শাজাহান এক সময়ে ছিল আমিনেরই ঘনিষ্ঠ।
দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের কৈলাসপুর, আমদহি, জগন্নাথপুর, মাধাইগঞ্জ এলাকায় কয়লা মাফিয়াদের দাপট দীর্ঘ দিনের। এক সময়ে মাফিয়া ও তাদের দলবলকে ভোটের সময়ে ব্যবহারের অভিযোগও উঠত রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধে। বাম আমলে কয়লা মাফিয়া শেখ সেলিমকে সভা-সমিতিতেও দেখা যেত। একটা বড় সময় এই এলাকায় বেআইনি কয়লা কারবারে নেতৃত্বে ছিলেন শেখ সেলিম। পরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উত্থান হয় শেখ আমিনের, যিনি আবার সেলিমেরই ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। সেলিম ও আমিনের দলবলের মধ্যে এলাকা দখলে প্রায়ই গুলি-বোমার লড়াই বেধে যেত।
এলাকায় বেআইনি কয়লার কারবার বন্ধের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিলেন সিপিএমের লাউদোহা লোকাল কমিটির প্রবীণ সদস্য শেখ ফারুখ হোসেন-সহ কয়েক জন। ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই আমদহি গ্রামের কাছে কেন্দোলা মোড়ে খুন হন ফারুখ ও তাঁর সঙ্গী সুধীর বাউড়ি। সেই ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন সেলিম। ধরা পড়ে জেলে যান তিনি।
সেলিম গ্রেফতার হতেই এলাকায় জোর বাড়ে আমিনের দলবলের। সে বছরই সেলিমের ভাই শেখ জাহাঙ্গিরকে খুনের অভিযোগ ওঠে আমিনের বিরুদ্ধে। ২০০৯-এর ১৪ ডিসেম্বর সেলিমের ভাইয়ের কাঠগোলার দুই কর্মীকে গুলি করে খুনের ঘটনাতেও প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন আমিন। ২০১১-র ১৬ ফেব্রুয়ারি আমদহি গ্রামে দুই তৃণমূল কর্মীকে খুনে আমিন-সহ মোট কুড়ি জনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ হয়। সে বছর ২২ ফেব্রুয়ারি আমদহি থেকে গ্রেফতার করা হয় আমিনকে। এর মাস তিনেক পরে ২০০৯-এর জোড়া খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন তিনি।
সেই সময়ে জামিনে ছাড়া পান সেলিম। জেল থেকে বেরিয়ে অবশ্য নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। কৈলাসপুরের বাড়িতে আর যাননি। মাধাইগঞ্জে একটি বড়সড় বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে থাকতে শুরু করেন। স্থানীয় নানা সূত্রের দাবি, তখন তিনি সদ্য রাজ্যে ক্ষমতায় আসা তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টাও শুরু করেন। ২০১২ সালে এলাকার একটি স্কুলভোটে তৃণমূলের লোকজনের সঙ্গে প্রকাশ্যে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সে বছরই ২৫ অক্টোবরে বাড়ির কাছে দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হন সেলিম। তৃণমূলের একাধিক নেতা হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন। তবে অভিযোগ উঠেছিল, স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার সহযোগিতায় আমিনের কয়েক জন অনুগামী সেলিমকে খুন করে।
সেই খুনে আমিনের দলের ছ’জনকে গ্রেফতার করা হয়। যদিও পরে তারা সবাই জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। সেলিম খুন হওয়ার সময়ে আমিন জেলে ছিলেন। পরে হাইকোর্ট থেকে জামিন পান তিনি। কিন্তু জেল থেকে বেরোতেই আবার সেলিমকে খুনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার হন। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি জামিনে ছাড়া পান।
এর মধ্যে অবশ্য খুন-জখম বন্ধ হয়নি। ২০১২-র ৩১ ডিসেম্বর জোড়া এলাকায় খুন হয়। আমদহিতে গুলিতে খুন হন শেখ লালু। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গ্রামের অন্য প্রান্তে গুলিতে নিহত হন শেখ মন্টু। অভিযোগ, আমিন-ঘনিষ্ঠ লালুকে সেলিমের কয়েক জন অনুগামী খুন করে। তারা মন্টুর ভাই ধনেশ্বরকে ব্যবহার করে। লালুকে খুনের খবর পেয়েই কয়েক জন ধনেশ্বরের বাড়িতে চড়াও হয়। তাঁকে না পেয়ে মন্টুকে গুলি করা হয় বলে স্থানীয় সূত্রের দাবি।
মঙ্গলবার ফের রক্তাক্ত হল কৈলাসপুর। অজয়ের দু’পাড়ে বিভিন্ন থানায় মোট ২১টি খুনে অভিযুক্ত আমিনকে খুনের পিছনেও উঠে আসছে সেই এলাকা দখল ও এক সময়ের শাগরেদের শত্রু হয়ে ওঠার তত্ত্বই। পুলিশের একটি সূত্রের খবর, তাঁর এক সময়ের অনুগামী শেখ শাজাহান এলাকার কয়লা কারবারের রাশ হাতে নেওয়ায় আমিন ইদানীং মোরাম খাদানের ব্যবসায় ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু সেই কারবারেও নেমে পড়েন শাজাহান-ঘনিষ্ঠ শেখ কাশেম। সম্প্রতি স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ বেআইনি ভাবে মোরাম খাদান চালানোর অভিযোগ করায় প্রশাসন কাশেমকে আড়াই লক্ষ টাকা জরিমানা করে। শাজাহানের দলবলের সন্দেহ হয়, আমিনের ইন্ধনেই বাসিন্দাদের একাংশ এই অভিযোগ করেছে। ফলে, শত্রুতা বাড়ছিল। শাজাহান, কাশেমরাই আমিনকে খুন করেছে বলে পুলিশে অভিযোগ করেছে আমিনের পরিবার।
এ সবের মাঝে পুলিশের চিন্তা বেড়েছে এলাকায় আগ্নেয়াস্ত্রের রমরমা দেখে। পুলিশ কমিশনার লক্ষ্মীনারায়ণ মিনা জানান, বেআইনি অস্ত্র কোথা থেকে ও কী ভাবে এসেছে, তদন্ত হবে। আমিন খুনে অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতার করা হবে বলেও তাঁর আশ্বাস।
সেলিম খুন হয়েছিলেন ইদের আগের দিন। সেই খুনে অভিযুক্ত আমিন গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলেন ইদের সকালে নমাজ সেরে বেরিয়েই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy