Advertisement
১৬ মে ২০২৪

ষোলো বছর পার, অধরা কিনারা

রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, কটূক্তির ঘটনা হয়ে উঠেছিল প্রায় নিত্য দিনের বিষয়। অভিযুক্তেরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়াত। ভোটের সময়ে কাজে লাগানোর স্বার্থে তাদের পিছনে ছিল রাজনৈতিক মদতও।

এই আবাসনেই থাকত কমলেশ সিংহরা।

এই আবাসনেই থাকত কমলেশ সিংহরা।

নীলোৎপল রায়চৌধুরী
জামুড়িয়া শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৬ ০০:২৬
Share: Save:

রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, কটূক্তির ঘটনা হয়ে উঠেছিল প্রায় নিত্য দিনের বিষয়। অভিযুক্তেরা এলাকায় দাপিয়ে বেড়াত। ভোটের সময়ে কাজে লাগানোর স্বার্থে তাদের পিছনে ছিল রাজনৈতিক মদতও। তাই মুখ খোলার বিশেষ সাহস পেতেন না এলাকার মানুষজন। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব থেকে শুরু হওয়া বিবাদের জেরেই পরপর খুনের ঘটনা ঘটে যায় জামু়ড়িয়ার কেন্দায়।

সময়টা ২০০০ সালের গোড়ার দিক। আচমকা খুন-পাল্টা খুনে উত্তপ্ত হয়ে উঠল এলাকা। পুলিশ ও বাসিন্দাদের বক্তব্য, সেই সময়ের গোলমালে যে তিন জনের নাম জড়িয়েছিল, তাঁরা হলেন, প্রমোদ সিংহ, ১৬ বছরের নাবালক কমলেশ সিংহ এবং রাজকিশোর গোয়ালার।

পুরনো বাসিন্দাদের মতে, প্রমোদ সিংহ নামে এক ‘বাহুবলী’ ও তার দলবলের দাপটে তখন গোটা এলাকা অতিষ্ঠ। রাস্তাঘাটে মেয়েদের কটূক্তি, অকারণে কারও বাড়িতে চড়াও হওয়া, পাড়ায় গোলমাল করা— এ সবই তখন প্রমোদের দলবলের সৌজন্যে প্রতিদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। গোলামালের আঁচ পড়ে ইস্টকেন্দা খনিকর্মীদের আবাসনেও। সেখানেই তখন ছেলে কমলেশ ও মেয়েদের নিয়ে থাকতেন আদতে উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা এক খনিকর্মী।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, প্রায়শই কমলেশদের বাড়িতে ঢুকে উৎপাত শুরু করে প্রমোদ। কমলেশের দিদিদেরও কটূক্তিও করা হতো বলে অভিযোগ। প্রমোদদের এমন আচরণের প্রতিবাদ করে কমলেশ। কমলেশদের পাশের আবাসনেই থাকতেন রাজকিশোরবাবু। ওই আবাসনের পুরনো বাসিন্দাদের দাবি, তৎকালীন শাসকদল ও পুলিশের যোগাযোগ থাকার পরেও কোনও প্রতিবাদ করেননি রাজকিশোরবাবু। এই কারণেই কমলেশের সঙ্গে গোল বাধে রাজকিশোরের।

দু’হাজার সালের ১৮ জানুয়ারি। বাড়ির বাইরের ঘরে ঘুমিয়েছিলেন রাজকিশোরবাবুর স্ত্রী ফুলমণিদেবী (৫০)। রাজকিশোরবাবু জানান, তখন রাত ১০টা। আচমকা গোটা ঘরটা বিস্ফোরণ আর ফুলমণিদেবীর চিৎকারে কেঁপে ওঠে। ছুটে গিয়ে দেখেন, সামনের ঘরে পড়ে রয়েছে স্ত্রীর ঝলসানো দেহ। সঙ্গে সঙ্গে কেন্দা ফাঁড়িতে খবর দেওয়া হয়। রাজকিশোরবাবুর অনুমান, ‘‘জানলা দিয়ে কেউ বোমা মেরে যায়।’’ আবাসনের বাসিন্দাদের সন্দেহ কমলেশের দিকে পড়লেও রাজকিশোরবাবুর বক্তব্য, ‘‘রাতে খুনীকে চোখে দেখতে পাইনি। তাই অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীর নামেই অভিযোগ দায়ের করি।’’

• ২০০০ সালের ১৮ জানুয়ারি বোমা মেরে খুন ইস্টকেন্দা আবাসনের বাসিন্দা ফুলমণি গোয়ালা।

• ওই বছর ১১মে ফুলমণির পড়শি কমলেশ সিংহকে খুন। অভিযুক্ত প্রমোদ সিংহ-সহ সাত জন।

• ধৃত প্রমোদ সিংহ তিন মাস পরে জামিনে মুক্ত।

• দু’টি মামলার চার্জশিটে বলা হয়, ‘অপরিচিত কেউ খুন করেছে।’

ওই ঘটনার মাস খানেকের মধ্যেই ফের প্রমোদ-কমলেশের দ্বন্দ্বে ফের তেতে ওঠে এলাকা। ওই বছরেই ৯মে রাতে কমলেশের সঙ্গে প্রমোদের দলবলের গুলির লড়াই বাধে বলে এলাকাবাসীর দাবি। আরও দাবি, ‘লড়াই’ চলাকালীন পিস্তলটি খোওয়া যায় কমলেশের। তার ঠিক এক দিনের ব্যবধানে ১১মে ফাঁড়ি থেকে অদূরে কমলেশকে কিছু খুঁজতে দেখা যায় বলে জানান বাসিন্দাদের একাংশ।

বাসিন্দারা জানান, ওই দিন বেলা ন’টা নাগাদ আচমকা দেখা যায়, কমলেশকে তাড়া করছে প্রায় দশ জনের একটি দল। নিজেকে বাঁচাতে কমলেশ লাগোয়া একটি কুয়োতে ঝাঁপ দেয়। ওই দলটির এক জন কুয়ো থেকে তুলে আনে কমলেশকে। তারপরে ফাঁড়ি থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে প্রথমে পাথর দিয়ে আঘাত করে ও পরে গুলি করে খুন করা হয় কমলেশকে। খুনের পরেই ওই দলটি চম্পট দেয়।

কমলেশের বাবা প্রমোদ সিংহ-সহ মোট সাত জনের নামে অভিযোগ দায়ের করেন। দিন কয়েকের মধ্যেই পুলিশের জালে ধরা পড়ে প্রমোদ। বাকি অভিযুক্তদের অবশ্য নাগাল পায়নি পুলিশ। তিন মাস জেল খাটার পরে জামিনে মুক্তি পায় প্রমোদও। প্রমোদ ছাডা় পেয়েছে শুনেই স্বেচ্ছাবসর নিয়ে উত্তরপ্রদেশে বাড়ি ফিরে যান কমলেশের বাবা।

পুলিশের সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০৭ সালে দু’টি খুনের মামলারই চার্জশিট জমা দেওয়া হয়। তবে দু’টি চার্জশিটেই পুলিশের দাবি, ‘অপরিচিত কেউ খুন করে ফেরার হয়ে গিয়েছে’। ঘটনার পরে প্রমোদকেও আর এলাকায় তেমন দেখা যায়নি বলে মত বাসিন্দাদের। বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি প্রমোদের বাড়ির লোকজনও। ঘটনার ১৬ বছর বাদে এখনও পর্যন্ত দু’টি মামলার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য গ্রহণও শুরু হয়নি বলে জানা গিয়েছে।

এলাকার বাসিন্দা মুকুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, ‘‘ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ করে কমলেশ ছাড়াও খুন হয়েছিল ধর্মেন্দ্র সিংহ ও ভুতকা মণ্ডল নামে আরও দু’জন। ভুতকার পরিবার ভয়ে অভিযোগ দায়েরও করতে পারেনি। অন্য দু’টি ঘটনায় মামলা আদালতে ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে রয়েছে। আর এগোয়নি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Accused Police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE