কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প ঘুরে দেখলেন এনটিপিসির চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরী (ডান দিকে)। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়
আগামী সেপ্টেম্বর থেকে চালু হবে নির্মাণকাজ। চার বছরের মাথায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে প্রথম ইউনিট।
শনিবার বর্ধমানের কাটোয়ায় প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে এসে এমনটাই জানালেন এনটিপিসি-র চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরী। বিকেলে কলকাতায় ফিরে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীও তাঁকে দ্রুত কাজ শুরু করতে বলেছেন।
জমিজটের জেরে যে প্রকল্প আদৌ আর হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল, কার্যত এ দিন থেকেই তার চাকা আনুষ্ঠানিক ভাবে গড়িয়ে গেল। এ দিনই প্রথম প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখার পরে অরূপবাবু বলেন, “আগামী সেপ্টেম্বর থেকে আমরা প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিতে পারব। তার ঠিক চার বছরের মাথায় প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়ে যাবে। ছ’মাসের মাথায় দ্বিতীয় ইউনিটটিও চালু হয়ে যাবে।”
এই প্রকল্পটির জন্য বাম আমলেই ৫৫৬ একর জমি অধিগৃহীত হয়েছিল। তৃণমূল সরকার শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না করা, এমনকী জমি কেনায় মধ্যস্থতাও না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কাজ আটকে যায়। পরিস্থিতি বুঝে এনটিপিসি তাদের পরিকল্পনায় কাটছাঁট করলেও আরও ২২০ একর জমি দরকার। ইতিমধ্যে এনটিপিসি-র উদ্যোগে চাষিরা জমি দিতে ইচ্ছুক বলে সম্মতিপত্র দেওয়ার পরে সরকার নড়েচড়ে বসে। বিভিন্ন দফতরের হাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় ১০০ একর সরকারি জমি এনটিপিসি-র হাতে তুলে দেওয়া হবে বলেও জানান মুখ্যমন্ত্রী। তাঁরই নির্দেশে কাটোয়া মহকুমা প্রশাসন জমি কেনায় মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে আসে। গত ১০ জুন মহকুমাশাসকের ডাকা সর্বদল বৈঠকে সকলেই সাহায্যের আশ্বাস দেন। ঠিক হয়, অধিগ্রহণের সময়ে সরকার যে ভাবে জমির দাম নির্ধারণ করেছিল, সেই পদ্ধতি মেনেই এনটিপিসি চাষিদের দাম দেবে।
এনটিপিসি প্রথম থেকেই বলে এসেছে, জমি ও কয়লার সমস্যা মিটে গেলেই কাটোয়া প্রকল্পের কাজ তারা শুরু করে দিতে চায়। পশ্চিমবঙ্গে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়তে তারা যে বিশেষ ভাবে আগ্রহী সেটাও তারা সরকারকে জানিয়েছিল। এ দিন কাটোয়ায় এসে অরূপবাবু বলেন, “জমি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। স্থানীয় চাষি, রাজনৈতিক দল ও জেলা প্রশাসন খুবই সাহায্য করছে। চাষিরা ইচ্ছুক হয়ে জমি দিচ্ছেন। আমরা চাষিদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সবচেয়ে ভাল দাম দেব। প্রকল্প নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার আগে জমি কেনার কাজ শুরু হয়ে যাবে।”
এনটিপিসি-কর্তারা জানান, এই মাসের শেষ দিক থেকেই জমি কেনার প্রক্রিয়া শুরু করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ৬৬০ মেগাওয়েটের দু’টি ইউনিট চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনটিপিসি। চাইলে তারা আরও দু’টি ইউনিট করতে পারে, তার জন্য জমি সমস্যা হবে না বলে সর্বদল বৈঠকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের জন্য চিহ্নিত এলাকার বাইরে থাকা যতীনপুর ও আঙারপুর গ্রামের বাসিন্দারা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, এনটিপিসি কিনতে চাইলে তাঁরা ২০০ একর জমি বিক্রি করতে রাজি আছেন। এ দিন প্রকল্প এলাকার মধ্যে থাকা শ্রীখণ্ড গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান দীপক মজুমদার সরাসরি অরূপবাবুকে বলেন, “আমাদের এখানে জমি নিয়ে কোনও সমস্যা হবে না।” শুক্রবারই শোনা গিয়েছিল, চারটি না হলেও তিনটি ইউনিট গড়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে এনটিপিসি। এ দিন অরূপবাবুও বলে দেন, “জমি পাওয়া গেলে কাটোয়ায় আমরা আরও একটি ইউনিট করতে পারি।”
এ দিন বেলা সওয়া ১১টা নাগাদ হেলিকপ্টার থেকে নেমেই প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখেন অরূপবাবু। গোটা জায়গাটা ঘেরার নির্দেশ দেন সংস্থার স্থানীয় কর্তাদের। সংস্থা সূত্রের খবর, মোট ১০ কিলোমিটার জায়গা ঘিরতে হবে। আগেই রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম (পিডিসিএল) ছ’কিলোমিটার পাঁচিল দিয়ে রেখেছে। বাকি চার কিলোমিটার কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হবে। দু’টি ইউনিট গড়ার জন্য চুড়পুনি, কোশীগ্রাম, দেবকুণ্ডু এবং শ্রীখণ্ড মৌজার জমি চিহ্নিত করা হয়েছে। চেয়ারম্যান চুড়পুনিতে গেলে সংস্থার দুই কর্তা শিবাশিস বসু ও রজতশুভ্র বসু মানচিত্র বের করে তাঁকে দেখান, ভাগীরথী থেকে কোন দিক দিয়ে প্রকল্প এলাকায় জল আসবে। মৌজার ভিতরে থাকা একটি সেচখালের ব্যাপারে খোঁজ নেন চেয়ারম্যান। দুই কর্তা জানান, গত কুড়ি বছর ওই সেচখাল দিয়ে ডিভিসি ব্যারাজের জল আসেনি। এ দিকে, ভাগীরথী থেকে প্রকল্প এলাকা আট কিলোমিটার দূরে। পরে দফতরে এসে অরূপবাবু স্থানীয় আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
জমি এবং জল ছাড়া আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল জ্বালানি কয়লার জোগান নিশ্চিত করা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কয়লা মন্ত্রক বীরভূমের দেউচা-পাঁচামি বলে নতুন একটি কয়লাখনি রাজ্য সরকারকে দিয়েছে। অরূপবাবু বলেন, “রাজ্য সরকার যে নতুন খনি পেয়েছে, সেখান থেকেই তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কয়লা আসবে। কয়লা নিয়ে সমস্যা নেই।” তিনি জানান, উৎপাদিত বিদ্যুতের ৮৫ শতাংশ রাজ্য সরকার কিনে নেবে বলে জানিয়েছে। বাকি বিদ্যুৎ তাঁদের হাতে থাকবে। দশ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের জন্য রেলকে চুক্তিমত টাকা দেওয়া হয়ে গিয়েছে। অজয় নদের উপর বড় সেতু তৈরি করা হবে বলেও জানান অরূপবাবু।
বিকেলে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে এনটিপিসি-র চেয়ারম্যান বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, দ্রুত কাজ শুরু করুন। আমি তাঁকে বলেছি, সেপ্টেম্বরেই আমরা নির্মাণের কাজ শুরু করছি। তাঁকে কাটোয়ায় আসতে বলেছি।” পূর্ব পরিচিতির সূত্রে অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন তিনি।
দিনের শেষে স্বস্তিতে সব মহলই। প্রকল্প এলাকার জমিমালিক সোহম দে, উজ্জ্বল গুপ্তরা বলেন, “এখানকার চাষিরা যে কাটোয়াকে সিঙ্গুর হতে দিলেন না, এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে ভাল খবর।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy