কয়লা পাচারের এই দৃশ্য ছিল খুবই স্বাভাবিক। ফাইল চিত্র।
ফল চাই চটজলদি। তাই নজর দেওয়া হয়নি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায়।
এই শতকের শুরুতে দুর্গাপুরের জন্য এই রকমই শিল্পনীতি নেওয়া হয়েছিল। আর এখন তার ফল ভুগছে শহরমনে করছে বণিক মহলের একাংশ।
দুর্গাপুরের অর্থনীতি বরাবর শিল্পনির্ভর। স্বাধীনতার পরে এই শহরে শিল্প গড়ে উঠেছিল মূলত সরকারি উদ্যোগে। পরিস্থিতি বদলায় আটের দশকে। নানা কারণে সেই সব কারখানা রুগ্ণ হতে শুরু করে। ফলে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও পড়তির দিকে যায়। নয়ের দশকের মাঝামাঝি ডিএসপি-তে বড়সড় আধুনিকীকরণ প্রকল্প হাতে নেয় কেন্দ্রীয় সরকার। পাশাপাশি, তৎকালীন রাজ্য সরকারের নতুন শিল্পনীতির হাত ধরে এই শিল্পাঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক স্পঞ্জ আয়রন, পিগ আয়রন, ইনগট, ফেরো অ্যালয়, সিমেন্ট কারখানা। হাজার হাজার ছেলেমেয়ের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে ওঠে। লোকজনের আনাগোনা বাড়ে। শহরবাসীর পকেট ভারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফের চাঙ্গা হয়ে ওঠে বাজার। সরকারি উৎসাহে গড়ে ওঠে একের পর এক শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স।
পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে রাজ্যে ক্ষমতার হাতবদলের পরে।
বেসরকারি কারখানায় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, বাম আমলে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে কারখানা গড়ার জন্য তাঁদের কার্যত ‘জামাই আদর’ করে আনা হয়েছিল। জমি, জল, বিদ্যুৎসবেরই ব্যবস্থা হয়েছিল সুলভে। বাম সরকারের শিল্পায়ন নীতি সফল করতে অনেক সময়ে শ্রমিক স্বার্থ ভুলে আপোষের রাস্তায় হাঁটার অভিযোগও উঠেছিল সিটুর বিরুদ্ধে। সেই সময়ে রাজ্যে পরিকাঠামো উন্নয়নে বিশেষ নজর দিয়েছিল রাজ্য সরকার। ফলে, উৎপাদিত পণ্যের স্থানীয় বাজার ছিল। এর বাইরেও ছিল আর একটি বড় কারণ। এক বিনিয়োগকারীর কথায়, “অনেক কারখানার মুনাফার পিছনে অন্যতম কারণ ছিল কয়লার রমরমা চোরা কারবার। ইসিএলের কাছ থেকে নিয়ম মেনে কয়লা কেনার খরচ ছিল দ্বিগুণেরও বেশি।” তিনি জানান, রাজ্যে পালাবদলের পরে এক ধাক্কায় অনেকখানি বদলে যায় পরিস্থিতি। কয়লার চোরা কারবারে লাগাম লাগানো হয়। আবার শিল্পায়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়নে সে ভাবে জোর না দেওয়ায় স্থানীয় বাজারেও মন্দা আসতে শুরু করে। বেশ কিছু কল-কারখানায় শ্রমিক-কর্মীরা বেতন না পেয়ে আন্দোলনে নামেন। কিছু কারখানা বন্ধও হয়ে যায়। কর্মহীন হন কয়েক হাজার মানুষ। উৎপাদন চালিয়ে কারখানাগুলির মধ্যেও অনেকের অবস্থা তেমন ভাল নয়। ব্যাঙ্ক ঋণ ও অন্য নানা কারণে বেশ কিছু কারখানা খাতায়-কলমে চালু দেখানো হচ্ছে। শ্রমিক-কর্মীদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। উৎপাদন বন্ধ। তবে শ্রমিক সংগঠনের ঘনিষ্ঠ কয়েক জনকে কাজে বহাল রাখা হয়েছে। ওই বিনিয়োগকারীর কথায়, “দুর্গাপুরের সার্বিক শিল্প পরিস্থিতি মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়।”
পুলিশ ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কয়লার চোরা কারবারে রাশ টানার প্রভাব পড়েছে অন্য ক্ষেত্রেও। এক পুলিশ আধিকারিকের দাবি, খনি অঞ্চলে কয়লার বেআইনি কারবার ছিল অনেকটা সমান্তরাল অর্থনীতির মতো। ধাপে ধাপে কয়লার টাকা পৌঁছে যেত বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হাতে। তাঁরা ভিড় জমাতেন শপিং মলে, মাল্টিপ্লেক্সে। বর্ষবরণ বা বর্ষশেষের পার্টিতে চড়া টাকায় টিকিট কিনতে লাইন পড়ত। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার রমরমা শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুরে। একে একে অফিস খুলে বসে বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থা। শুরু হয় তাদের রমরমা কারবার। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল ফ্ল্যাটবাড়ির দাম। একই চিত্র তৈরি হয় বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রেও। সুযোগ বুঝে বাড়ির চড়া ভাড়া হাঁকতে শুরু করেছিলেন বাড়ির মালিকেরা। পরিস্থিতি এমনই ছিল, কোনও সংস্থা ভাড়া নেওয়ার সময়ে দরাদরি পর্যন্ত করত না। স্কুল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ম্যানেজমেন্ট কলেজে লগ্নি আসতে শুরু করে।
বেঙ্গল সুবার্বান চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক প্রফুল্ল ঘোষের মতে, কয়লা কারবারে লাগাম এবং সারদা-কাণ্ডের পরে বাকি লগ্নি সংস্থাগুলি গুটিয়ে যাওয়ার বড় প্রভাব পড়েছে দুর্গাপুরের অর্থনীতিতে। বাজার সঙ্কুচিত হয়েছে। যথেষ্ট সংখ্যক ক্রেতা না পেয়ে একের পর এক ব্র্যান্ড এই শহর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে।
স্পঞ্জ, ফেরো অ্যালয়, ইস্পাত প্রভৃতি মিলিয়ে দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে বেসরকারি কারখানার সংখ্যা ৩১। তার মধ্যে অন্তত ১০টিতে এই মুহূর্তে প্রায় কোনও উৎপাদন নেই। ছাঁটাই হয়েছেন দু’হাজারেরও বেশি শ্রমিক। দুর্গাপুর মহকুমার কাঁকসায় বামুনাড়া শিল্পতালুকে ১৯টি কারখানা রয়েছে। ‘বামুনাড়া ইন্ডাস্ট্রিজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভাপতি অশোক সরাফ জানান, স্পঞ্জ আয়রন কারখানায় উৎপাদন কমার প্রভাব পড়েছে এই শিল্পাঞ্চলে। তাঁর দাবি, “একে রাজ্যে পরিকাঠামো উন্নয়ন তেমন হচ্ছে না। তার উপরে স্পঞ্জ আয়রন কারখানাগুলির দুর্গতি। ফলে, শিল্পাঞ্চলের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।” আবাসন নির্মাতারা জানান, বছর তিনেক আগে ভূমিপুজোর সময়েই সব ফ্ল্যাট বুক হয়ে যেত। এখন তৈরি ফ্ল্যাট পড়ে রয়েছে। পুরসভার হিসেবে, অন্তত ৫২টি লগ্নি সংস্থার অফিস ছিল সিটি সেন্টার এলাকায়। সেগুলির ঝাঁপ বন্ধ। সেই সব সংস্থার অনেক কর্মী পাওনাদার এড়াতে শহর ছেড়েছেন। ফলে, বাড়ি ভাড়ার হার কমেছে শুধু তাই নয়। বাড়ি ভাড়া চেয়েও মনের মতো ভাড়াটিয়া মিলছে না বলে জানান সিটি সেন্টারের বাসিন্দারা।
প্রফুল্লবাবু অভিযোগ করেন, গত তিন-চার বছরে শহরে নতুন কোনও শিল্প আসেনি। দুর্গাপুরের এমন পরিস্থিতির পিছনে তৎকালীন বাম সরকারের অপরিকল্পিত শিল্পায়নও দায়ী। শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, তারকা হোটেল গড়লেই সেটা উন্নয়ন নয়, তা টিকিয়ে রাখার জন্যও দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ নিতে হয়। সে কথা মাথায় ছিল না শিল্পায়নের তৎকালীন কারিগরদের। প্রফুল্লবাবুর কথায়, “বাম আমলে তেমন কোনও বড় বা স্থায়ী শিল্প দুর্গাপুরে হয়নি। ফলে বলিষ্ঠ অর্থনীতি গড়ে ওঠেনি। তার ফল ভুগছে আজকের দুর্গাপুর।”
দুর্গাপুরের সিপিএম নেতা বিপ্রেন্দু চক্রবর্তীর অবশ্য দাবি, “শিল্পের ধরন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টায়। আমাদের সময়ে এ কথা মাথায় রেখেই কারখানাগুলি গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে দেখভালের অভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy