দামোদরের পাড় ঘিরে চলছে অবাধে বালি তোলা। হিজলনায় ছবি তুলেছেন উদিত সিংহ।
বালি বোঝাই ট্রাকের দাপটে এক দিকে ভাঙছে রাস্তা, অন্যদিকে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে ডিভিসি সেচখালের উপর অসংখ্য সেতু। এমনকী ক্রমাগত বালি কাটায় দামোদরের খাতের গতিপথই বদলে যেতে বসেছে বলে সেচ দফতর সূত্রের খবর। স্থানীয় মানুষের দাবি, পুলিশ প্রশাসনের তরফে ঠিক মতো নজরদারি হচ্ছে না। আর পুলিশ বলছে, সবটা তাদের হাতে নেই। অনেকক্ষেত্রেই অন্যান্য দফতরের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হয়। ফলে অনেক কিছু জানলেও নিয়মের গ্যাঁড়াকলে আটকে অনেকটাই না করা রয়ে যায়।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালে বালি বা মাটি বোঝাই ৬৪১টি ট্রাক আটক করেছিল পুলিশ। ১৪,৫১,৫১০ টাকা ফাইনও করা হয়। পরে জেলা ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের হাতে ট্রাকগুলি তুলে দেওয়া হয়। তারাও ৬৮,৪৫,৫৪২ টাকা ফাইন করে। ২০১৩ সালে আটক করা ট্রাকের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৫৮টিতে। সেই যানগুলির কাছ থেকে জরিমানা বাবদ আদায় করা হয়েছিল ৪৪,৩২,০৫০ টাকা। পরে ভূমি ও ভুমি রাজস্ব দফতর আরও ৭৫,৪৪,৩৯০ টাকা আদায় করে। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩৮টি ট্রাক আটক করা হয়েছে। পুলিশ জরিমানা করেছে ৮৪,৫৫০ টাকা।
তবে এই পরিসংখ্যান সিন্ধুতে বিন্দু। জেলা পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, যত ট্রাক চোরাই মাটি বা বালি ওভারলোড করে যাতায়াত করছে, তার সামান্য অংশই আটক করা সম্ভব হচ্ছে। কারণ, পুলিশ সাধারণত দিনে অভিযান চালায়। আর পাচারকারীদের সক্রিয়তা বাড়ে রাতে। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, পুলিশের অত পরিকাঠামো কোথায় যে বড় আকারে বালি বোঝাই ট্রাক আটকে কাগজপত্র দেখবে।
জেলা পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা বলেন, “এই বালি বা মাটি বোঝাই ট্রাকদের অনুমোদিত ওজনের চেয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলা বন্ধ করতে ক্রমেই সরকার কঠোর হচ্ছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের সার্কুলার এসেছে জেলা প্রশাসনের কাছে। তাতে বলা হয়েছে এই ধরনের সমস্ত যানের ওভারলোডিংয়ের জেরে রাস্তা ভাঙছে, সেতু বিপন্ন হয়ে পড়ছে। তাই ভূমি দফতরকে বলা হয়েছে পুলিশের সাহায্যে ট্রাকগুলিকে পরীক্ষা করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে ওভারলোডিং ঠেকাতে। কিন্তু পুলিশের হাতে অতিরিক্ত মাল বহনকারীট্রাকের বিরুদ্ধে আইনত মামলা রুজু করার ক্ষমতা এখনও দেওয়া হয়নি। ফলে আমরা বালি বা মাটি বোঝাই ট্রাক আটক করে প্রথমে মোটর ভেহিক্যাল দফতরের আইন ভাঙার দায়ে ওদের জরিমানা করছি। তারপরে খবর দিচ্ছি ভূমি রাজস্ব দফতরে।”
জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ওই বালি বা মাটি বোঝাই ট্রাকগুলির অধিকংশেরই হেডলাইট থাকে না, থাকে এয়ার হর্ন। অনেকক্ষেত্রেই চালকের কাছে লাইসেন্স থাকে না, বেপরোওয়া গতিতে গাড়ি চালাতে দেখা যায় খালাসিকে। ফলে এদের বিরুদ্ধে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে এমন মামলা দেওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের আশা, প্রথমে পুলিশ পরে ভূমি দফতরের জরিমানার কবলে পড়ে ভবিষ্যতে আর সেই যানটি আইন ভাঙবে না।
তবে পরিসংখ্যান বলছে, একবার বিপুল অঙ্কের জরিমানা দেওয়ার পরেও ট্রাকগুলি সাবধান হচ্ছে না। ফলে বছরের পর বছর আইনভাঙা ট্রাকের সংখ্যা বাড়ছে। তবে এর পিছনে জেলায় অবৈধ বালি খাদানের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়াও একটা কারণ বলে মনে করে প্রশাসন। জেলা জুড়ে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরের ১২টি চেকপোষ্ট বা টোল আদায়ের কেন্দ্র রয়েছে। এই ১২টি কেন্দ্রে বালি বোঝাই সমস্ত ট্রাককে অবাধে যেতে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। প্রশাসনের একটি সূত্রের অভিযোগ, সামান্য কিছু টাকা নিয়ে ওই কেন্দ্রের কর্মীরা ওভারলোডিং হয়েছে বুঝেও ট্রাকগুলিকে নদীর ধার থেকে উঠে আসতে দিচ্ছেন। ফলে সরাসরি বেশি ওজনের চাপে নষ্ট হচ্ছে রাস্তা। অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি সংস্কার) অশোক সাহা বলেন, “টাকার বিনিময়ে ওভারলোডেড ট্রাকগুলিকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ আসেনি। তবে এটা ঠিক যে ওই কেন্দ্রগুলিতে সমস্ত ট্রাক দাঁড়াচ্ছে না। একমাত্র পুলিশ থাকলে ট্রাকগুলি দাঁড়াচ্ছে।”
অভিযোগ, গোলমাল রয়েছে বালি খাদানের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও। প্রশাসন সূত্রের খবর, সারা বছর বালি তোলার জন্য একটি নিদিষ্ট অঙ্কের টাকা দেওয়ার চুক্তি করে বালিখাদ লিজ নেওয়া হয়। কিন্তু সামান্য কিছু টাকা অগ্রিম দেওয়ার পরেই দেখা যায় বালি তোলা চললেও সরকারের কাছে বকেয়া রাজস্ব জমা পড়ছে না। একবছর পরে আর খোঁজ মিলছে না লিজ নেওয়া ব্যক্তির। বিএলএলআরও অফিস কালো তালিকাভূক্ত করছে ওই ব্যক্তিকে। পরের বার একই বালিখাদ লিজে নেওয়ার সময় এলে ওই ব্যক্তি ফের নাম ভাঙিয়ে সর্বোচ্চ দর দিয়ে বালিখাদের লিজ নিচ্ছে বলে অভিযোগ। আবারও একই ঘটনা ঘটছে। একবার লিজ নেওয়ার পরে যত বেশি সংখ্যক ট্রাককে দিয়ে খাদান থেকে বালি তোলার প্রবণতাও বাড়ছে।
প্রশাসনের এক কর্তার দাবি, বালি খাদান লিজ দেওয়ার সময় সমস্ত টাকা একসঙ্গে নেওয়ার প্রথা এখনও চালু করতে পারেনি ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর। ফলে নদীর তীর ঘেঁষা রাস্তায় একদিকে অসংখ্য ট্রাকের দাপাদাপি বাড়ছে, অন্যদিকে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিএলএলআরও দফতর ঠিকমতো খতিয়ে না দেখে লিজ দেওয়ায় গোলমাল বাড়ছে বলেও অভিযোগ। প্রশাসনের এক সূত্রের খবর, খাদানের একটা অংশে একজনকে লিজ দেওয়ার পরে আরেক জনকে আরেক অংশে নতুন করে লিজ দেওয়া হচ্ছে। অথচ জমিতে ঢোকার কোনও রাস্তা পাচ্ছেন না নতুন লিজ নেওয়া ব্যক্তি। আগের জমি লিজ নেওয়া ব্যক্তির জমি ব্যবহার করেই তাকে খাদানে ঢুকতে হচ্ছে। ফলে আগে লিজ নেওয়া ব্যক্তি আপত্তি করছেন। বাধছে ঝামেলা। কখনও বড় সংঘর্ষও বাধছে। জেলা ভূমি রাজস্ব দফতরের এক কর্তার আশ্বাস, “প্রতি বছর কোন জমিতে লিজ দেওয়া হচ্ছে, তার একটি বিস্তারিত ম্যাপ তৈরি করার কথা ভাবা হচ্ছে।”
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy