বাড়িতে টিভি নেই। কারণ, ছেলে টিভি দেখে না। কম্পিউটর রয়েছে, তবে ইন্টারনেট নেই। কম্পিউটরে গেম আর নিয়ম করে খবরের কাগজ পড়াই অবসরের রসদ। আর মনে রাখে রামকৃষ্ণ মিশনে থাকার সময়ে শেখা সেই কথাগুলো, পড়াশোনার পাশাপাশি করতে হবে শরীরচর্চাও। তাতে বাড়বে মনোসংযোগ। উচ্চ মাধ্যমিকের মেধাতালিকায় রাজ্যে অষ্টম স্থান পাওয়া দুর্গাপুরের অর্কদেব রায়ের ভাল ফলের মূল কারণ সেই মনোসংযোগ, বলছেন তার বাবা-মা।
নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে মাধ্যমিকে রাজ্যে চতুর্দশ স্থান পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল অর্কদেব। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় দুর্গাপুরের বিধানচন্দ্র ইনস্টিটিউশন অফ বয়েজ স্কুলে। এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে সে পেয়েছে ৪৬৯। তার মধ্যে স্ট্যাটিস্টিক্স-এ ১০০, রসায়ন ও অঙ্কে ৯৯ করে। ফল বেরোনোর পরে অর্কদেব বলে, “পরীক্ষা ভাল হয়েছিল। তবে ফল এত ভাল হবে, ভাবিনি।” তার স্কুলের অধ্যক্ষ উজ্জ্বল সরকার বলেন, “অর্কদেবের সাফল্যে আমরা গর্বিত।”
অর্কদেবের বাবা বেণীমাধববাবু সেচ দফতরের বাস্তুকার। বোলপুর থেকে বর্ধমানে বদলি হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। ছোট ছেলে অর্ককে দুর্গাপুরের স্কুলে ভর্তি করে এই শহরে চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ে ভাড়া রয়েছেন সপরিবারে। তিনি জানান, বড় ছেলে শিবাশিস ইঞ্জিনিয়ারি। রাজস্থানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। বাড়িতে তিনি ও তাঁর স্ত্রী কাকলীদেবী থাকেন ছোট ছেলেকে নিয়ে। তিনি জানান, ছেলে টিভি দেখে না। ইন্টারনেটের যেটুকু প্রয়োজন তা পাড়ার সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে সেরে নেয় অর্ক। তবে খেলাধুলোয় তার বিশেষ আগ্রহ।
দুর্গাপুরে নিজের বাড়িতে অর্কদেব রায়। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
অর্কদেবের মা কাকলীদেবী জানান, ছেলে বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণের উপরে লেখা বই পড়তে ভালোবাসে। অর্কদেব বলে, “রামকৃষ্ণ মিশনে শেখানো হতো, শুধু পড়াশোনা নয়, খেলাধুলো, শরীরচর্চা করতে হবে। আমি তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।” ছেলে সম্পর্কে বেণীমাধববাবু বলেন, “মনোসংযোগ খুব বেশি। পরীক্ষার আগে সপ্তাহখানেক মন দিয়ে পড়াশোনা করেছে। তাতেই এমন ফল।” অর্কদেব এখন আইআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়। পরে আইএএস পরীক্ষায় বসতে চায়। এ দিকে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটেও সুযোগ পেয়েছে সে। বেণীমাধববাবু বলেন, “ও অনেক রকম পরিকল্পনা শোনায়। আমি চাই, ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন-এ ভর্তি করতে। তা হলে ভবিষ্যতে ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অগার্নাইজেশন (ডিআরডিও) থেকে গবেষণাও করতে পারবে।”
বাড়িতে টিভি নেই কাটোয়ার ভারতী ভবন স্কুলের ছাত্র সৌরভ পালেরও। নেই কম্পিউটারও। সকাল থেকেই টেনশনে ছিল সে। কিন্তু বাড়ির সামনে ভিড় জমতে দেখে বুঝতে পারে, ভাল খবর রয়েছে। আত্মীয়স্বজন থেকে শিক্ষকের ভিড় উপচে পড়ার পরে সৌরভ জানতে পারে, এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে ৪৭৫ পেয়ে রাজ্যে সম্ভাব্য দ্বিতীয় সে-ই।
ভরসা দু’বিঘা জমি। তাতে চাষাবাদ করেই সংসার চালান সৌরভের বাবা বিভাসবাবু। তিনি বলেন, “আমাদের একটা রেডিও আছে। টিভি কিনতে পারিনি। এর বন্ধুর কাছে খবর পেয়েও বিশ্বাস হয়নি।” সৌরভ পড়াশোনা করেছে কাটোয়া স্টেডিয়ামের কাছে মামারবাড়িতে থেকে। সাহায্য করেছে কলকাতার এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। স্কুলের তরফে হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। জীবনের একটি বড় ধাপ পেরিয়ে এ বার মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগের দিকে নজর সৌরভের।
টিভিতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির খেলা ও কম্পিউটরের সামনে সময় কাটিয়েও অবশ্য ভাল ফল করেছে বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল স্কুলের পরমেশ দাস। ব্যাঙ্ককর্মী শম্ভুনাথ দাসের ছেলে পরমেশ ৪৭৪ পেয়ে রাজ্যে সম্ভাব্য তৃতীয়। এই স্কুলেরই সৌরভ চক্রবর্তী ৪৭১ পেয়ে সম্ভাব্য ষষ্ঠ। বর্ধমান সিএমএস স্কুলের শেখ মহম্মদ সাগির ৪৬৮ পেয়ে মেধাতালিকায় নবম স্থানে রয়েছে। পরমেশ, সৌরভও চায় ইঞ্জিনিয়ার হতে। শুধু সাগিরের লক্ষ্য চিকিৎসক হওয়া।
(সহ-প্রতিবেদন: সৌমেন দত্ত ও রানা সেনগুপ্ত)