আদালতে ধৃতেরা। —নিজস্ব চিত্র।
বাসে ওঠার সময়েই নজরে পড়েছিল, বাসের কর্মী মোবাইলে ছবি তুলছে। প্রতিবাদ করলে সেই কর্মী তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। আশপাশ থেকে ছুটে এসে ওই বাসকর্মীর উপরে চড়াও হন লোকজন। ফোনে খবর পেয়ে তরুণীর কয়েক জন সহকর্মী ছুটে এলে তাঁদের উপরে চড়াও হয় মিনিবাস কর্মীদের একাংশ। জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি দু’জন। বুধবার সন্ধ্যায় দুর্গাপুরের প্রান্তিকা বাসস্ট্যান্ডে এই ঘটনার পরে আতঙ্কে মহিলা নিত্যযাত্রীরা। ভরসন্ধ্যায় এমন ঘটনায় শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বাসিন্দাদের একাংশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার সন্ধ্যায় মোবাইলে ছবি তোলা নিয়ে ওই তরুণী যখন প্রতিবাদ করেন, মিনিবাস কর্মী দীপক দাস তাঁকে তখন রীতিমতো শাসায়। শ্লীলতাহানিরও চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। আশপাশ থেকে অনেকে ছুটে আসেন। মিনিবাস কর্মীদের একাংশও ঘটনার প্রতিবাদ করেন। কিন্তু দীপক তখনও চোটপাট করছিল। দীপককে মারধরও করেন কেউ-কেউ। তত ক্ষণে একটি টিভি চ্যানেলের কর্মী ওই তরুণী তাঁর সহকর্মীদের খবর দেন। তিন জন সাংবাদিক পৌঁছলে হঠাৎ মিনিবাস কর্মীদের একাংশ রড, মদের বোতল নিয়ে রে-রে করে তেড়ে আসে ও মারধর শুরু করে বলে অভিযোগ। এক জনের নাক ফেটে রক্ত গড়াতে থাকে। খবর পেয়ে অন্য সাংবাদিকেরা গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাঁদের উদ্ধার করে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে পাঠান। দু’জনকে ভর্তি করানো হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে এক জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ডালিম খান ও বাতায়ন ভট্টাচার্য নামে আরও দুই মিনিবাস কর্মীকে গ্রেফতার করে। বৃহস্পতিবার তিন জনকেই আদালত ৫ দিনের জন্য জেল-হাজতে পাঠায়। পুলিশ জানায়, অভিযুক্ত আরও কয়েক জনের খোঁজ চলছে।
এই ঘটনার পরে অনেক যাত্রীই প্রশ্ন তুলেছেন, ওই তরুণীর সমর্থনে তাঁর সহকর্মীরা এগিয়ে এসেছিল বলে হয়তো তিনি আরও হেনস্থার হাত থেকে নিস্তার পেয়েছেন। কিন্তু যাঁদের ক্ষেত্রে তা হবে না, তাঁদের নিরাপত্তা কোথায়? দুর্গাপুর স্টেশন থেকে রোজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন বর্ধমানের এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী বিপাশা রায়। তিনি বলেন, “বাসে যাত্রীরা থাকলে ঠিক আছে। কিন্তু রাতের বাসে যাত্রী খুব বেশি থাকেন না। এটা বেশ দুশ্চিন্তার।” তাঁর দাবি, যাত্রী না থাকায় কেমন বেপরোয়া হতে পারেন মিনিবাস কর্মীরা তার নমুনা তিনি আগেও দেখেছেন। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে এক দিন সিটি সেন্টার বাসস্ট্যান্ডে সেপকো হয়ে বি-জোন যাওয়ার একটি মিনিবাসে চাপেন তিনি। বাসটি গন্তব্যের দিকে কিছুটা গিয়ে যাত্রী না থাকায় ফের সিটি সেন্টার বাসস্ট্যান্ডে ফিরে আসে। পরে কিছু যাত্রী হওয়ায় সেটি ফের রওনা হয়। বিপাশাদেবীর ক্ষোভ, “এ ভাবে কি কোনও বাস রুটে চলার এক্তিয়ার আছে? যাত্রীদের কি সময়ের কোনও দাম নেই?” প্রতিবাদ করায় এক মিনিবাস কর্মী অভব্য আচরণ করেন বলেও তিনি অভিযোগ জানিয়েছিলেন মহকুমা প্রশাসনের কাছে। তৎকালীন মহকুমাশাসক মৌমিতা বসু বাস মালিকদের ডেকে অভিযুক্ত কর্মীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নির্দেশও দিয়েছিলেন।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এ-জোনের ডালিয়া রায়। তিনি বলেন, “মিনিবাস কর্মীদের মধ্যে বেশির ভাগ জনই ভাল ব্যবহার করেন। কিন্তু দু’এক জন অন্য রকম। মাঝে-মধ্যে সত্যিই অসহায় লাগে।” মহিলা নিত্যযাত্রীদের অনেকেই অবশ্য জানান, শহরের সব বাসস্ট্যান্ডে বাসকর্মীদের রাজনৈতিক সংগঠনের যে কার্যালয় রয়েছে, সেখানে গিয়ে অভাব-অভিযোগ জানালে অনেক ক্ষেত্রেই ফল মেলে, এটাই ভরসার। কিন্তু সন্ধ্যার পরে শহরের অনেক এলাকাতেই রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যায়। শুধু বাস নয়, যে কোনও যানবাহনে চলাফেরা করতেই নিরাপত্তার অভাব বোধ হয় তখন, অভিযোগ অনেক বাসিন্দার।
মিনিবাস কর্মীদের একাংশের বুধবারের আচরণ নিয়ে বিব্রত মিনিবাস কর্মী ও মালিক সংগঠনগুলি। তাদের দাবি, শত-শত বাসকর্মীর মধ্যে দু’এক জনের আচরণের জন্য সবার বদনাম হয়। আইএনটিটিইউসি-র সংগঠনের দায়িত্বে থাকা শহরের তৃণমূল কাউন্সিলর চন্দন সাহা বলেন, “বুধবার সন্ধ্যায় যা হয়েছে তা মোটেও কাম্য নয়। আমরা দোষীদের পাশে নেই। প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করুক, আমরা সহযোগিতা করব।’’ একটি বাসমালিক সংগঠনের পক্ষে কাজল দে বলেন, “যাত্রীদের নিরাপত্তা সব সময় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বাসকর্মীরা আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। কিন্তু বুধবার যা হয়েছে, তা মোটেই কাম্য নয়।” দুর্গাপুরের মহকুমাশাসক কস্তুরী সেনগুপ্ত বলেন, “শুধু মহিলা নয়, সমস্ত যাত্রীর সুরক্ষার দিকটি সুনিশ্চিত করতে হবে। বাসকর্মীদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বুধবারের ঘটনায় যুক্তদের ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy