শহরের নানা জায়গায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিকশা।
লোকসংখ্যা বাড়লেও পরিষেবা সেই মান্ধাতা আমলেই আটকে রয়েছে কালনায়।
শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে যেতে ভরসা সেই রিকশা। ঘিঞ্জি বাজার, বাসস্ট্যান্ড, ভাঙা এসটিকেকে রোড, বেহাল নিকাশিএ সব নিয়েই দিন কাটছে কালনাবাসীর।
শহরবাসীর অভিযোগ, একদিকে ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে, জামাকাপড়ের মল তৈরি হচ্ছে কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনও উন্নতি নেই। পুরনো শহর হওয়ায় রাস্তাঘাট এমনিতেই তেমন চওড়া নয়, তার উপর বেআইনি দখলে রাস্তা দিনদিন আরও সরু হয়ে যাচ্ছে। ফলে টাউন সার্ভিস বাস চলাচলের উপায় নেই। অটো চলে মাত্র একটি রুটে। বাকি শহরে যাতায়াতের ভরসা সেই রিকশা। আবার রিকশা ভাড়ারও নির্দিষ্ট তালিকা না থাকায় রোজকার মুশকিল পিছু ছাড়ে না শহরবাসীর। বাসিন্দাদের দাবি, বৈদ্যপুর থেকে পুরনো বাসস্ট্যান্ড, কিংবা শহরের যে কোনও সরকারি কার্যালয়ে যেতে রিকশায় উঠলেই ৫০-৬০ টাকা খরচ হয়ে যায়। তার উপর বাইরে থেকে কেউ এলে আরও বেশি ভাড়া দাবি করেন রিকশা চালকেরা। ভাড়ার হেরফের নিয়ে অভিযোগ ওঠায় বছর দেড়েক আগে শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে তালিকা টাঙিয়েছিল পুরসভা। কিন্তু অযত্নে বেশিরভাগ তালিকাই আর পড়া যায় না। গ্রাম থেকে প্রায়দিনই কালনা শহরে আসেন অঙ্কুর মল্লিক। তাঁর অভিযোগ, পুরসভা ভাড়ার তালিকা টাঙালেও লাভ হয় নি। একই রাস্তায় একেক জন রিকশা চালক একেক রকম ভাড়া নেন। ফলে খুব প্রয়োজন না হলে শহরের রিকশায় চড়তে চান না গ্রামবাসী।
আশপাশের গ্রাম থেকে পাকাপাকি ভাবে লোকের আসা বাড়লেও নিত্য প্রয়োজনে যাতায়াত কমার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন শহরের ব্যবসায়ীরাও। সাহু সরকার মোড়ের রেডিমেড পোশাকের দোকানের মালিক সুমিত বসুর দাবি, এ শহরের ব্যবসা গ্রামের মানুষের উপর অনেকটাই নির্ভর করে। যে কোনও প্রয়োজনে শহরে এলেই কেনাকাটা করার অভ্যেস ছিল অনেকেরই। এমনকী বাইরে থেকে গঙ্গাস্নানে এলেও ফেরার পথে জামাকাপড় কিনতেন বহু লোক। কিন্তু রিকশা ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিনের এই যাতায়াত অনেকটাই কমেছে বলে দাবি সুমিতবাবুর। এছাড়া ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাসস্ট্যান্ড শহরের মধ্যেই ছিল। ঘিঞ্জি শহরকে দূষণমুক্ত করতে বাসস্ট্যান্ড সরিয়ে শহরের বাইরে নিয়ে যায় কালনা পুরসভা। তাতে বাসের ভিড় কমলেও বাসস্ট্যান্ড যাতায়াত মুশকিল হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের দাবি, শহরে মূল অংশে অটো অথবা ওই ধরনের ছোট যান চালানো হলে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হবেন। উল্লেখ্য, এখন শুধুমাত্র স্টেশন থেকে খেয়াঘাট রোডে অটো চলাচল করে।
বছর দেড়েক আগে পরিবহণ দফতর থেকে অটো চালানোর অনুমতি পান শহরের যুবক সঞ্জয় বৈরাগ্য। তবে অনুমতি পেয়েও শহরে অটো চালাতে পারেন নি তিনি। সঞ্জয়ের কথায়, “নতুন অটো নিয়ে রাস্তায় নামতেই পথ আগলে ধরে রিকশা চালকেরা। বাধ্য হয়ে অটো চালানো বন্ধ করে দিতে হয়।” যদিও কালনা শহরে অটো চালানোর যৌক্তিকতা রয়েছে বলে মানছেন তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নেতা অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “শহরে অটো চালানোর প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের তেমন আপত্তিও নেই। তবে শহরের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি দেখতে পর্যটকেরা রিকশাতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন।” আগামী দু’দশক কালনা কি তাহলে রিকশাতেই থেমে থাকবে? পুরপ্রধান বিশ্বজিৎ কুণ্ডু জানান, রিকশা ভাড়ার কারণে অনেকে শহরে আসতে চাইছেন না তা ঠিক। তবে অটো চালানোর ব্যাপারে পুরসভার কিছু করার নেই। কারণ এর অনুমোদন দেয় জেলা পরিবহণ দফতর। রিকশা চালকেরা টোটোর মতো ছোট যান চালাতে চাইলে পুরসভা তাদের পাশে থাকবে।
রাস্তা জুড়ে পড়ে রয়েছে বালি-সিমেন্ট।
যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতির জন্য বাসিন্দাদের বহু বছরের দাবি, নদিয়া জেলার সঙ্গে সংযোগকারী ভাগীরথী নদীর উপর একটি কংক্রিটের লম্বা সেতু তৈরির। তাঁদের দাবি, নদিয়ার মায়াপুরে প্রতিদিন হাজার হাজার দেশবিদেশের পর্যটক আসেন। ভাগীরথীর সেতুটি চালু হলে সেই পর্যটকদের কিছুটা অংশ অন্তত কালনার দর্শনীয় স্থানগুলি ঘুরতে আগ্রহী হবেন। তাতে ব্যবসার উন্নতিও হবে। এছাড়া ওই সেতু দিয়ে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের সঙ্গে কালনার এসটিকেকে রোডের যোগ তৈরি হবে। ফলে ট্রেনে কলকাতা যাতায়াতও সহজ হবে। অম্বিকা কালনা স্টেশনের উপর ভরসা না করে শান্তিপুর লোকাল ধরেও অনেকে কলকাতা আসাযাওয়া করতে পারবেন। পুরসভার তরফে জানা গিয়েছে, বর্তমান বোর্ড এ ব্যাপারে চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে সেতু তৈরির সার্ভের কাজ শেষ হয়েছে। বিষয়টি এখন পূর্ত দফতরের দেখভালে রয়েছে।
এছাড়া ফুটপাথ দখল করে একাধিক দোকান গজিয়ে ওঠা এ শহরের বরাবরের সমস্যা। কলেজ মার্কেট, তেঁতুলতলা, চকবাজার-সহ শহরের বেশ কিছু যায়গায় শুধু ফুটপাত নয়, দখল হয়ে গেছে পিচ রাস্তার দু’পাশের বেশ খানিকটা অংশ। ফলে সকালের ব্যস্ত সময়ে যানজট লেগেই থাকে। আরও অভিযোগ, নিকাশিনালা বন্ধ করেও অনেকে দোকান খুলে ফেলছেন। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জল জমে যাচ্ছে শহরের একাধিক এলাকায়।
শহরের আর এক অভাব খেলার মাঠ। এক দশক আগেও বহু খোলা জমিতে বল পায়ে দাপিয়ে বেড়াত ছেলেরা। কিন্তু লোকসংখ্যার চাপে শহর যেন কংক্রিটের জঙ্গল। বাসিন্দাদের ক্ষোভ, প্রতি বার ওয়ার্ডগুলিকে নিয়ে ফুটবল, ক্রিকেটের আসর বলে। অথচ সব ওয়ার্ডে খেলার জায়গাই নেই। শহরে মাঠ বলতে এখন অঘোরনাথ পার্ক স্টেডিয়াম, রাজবাড়ির মাঠ এবং মহিষমর্দিনীতলার মাঠ। মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক অমরেন্দ্রনাথ সরকার জানান, নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির কমপ্লেক্সের মধ্যে একটি খেলার মাঠ তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা হয় নি। যদিও পুরপ্রধানের আশ্বাস, ভাগীরথীর চরে খেলার মাঠ তৈরির চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বাসিন্দাদের আশঙ্কা, শহরের ভবিষ্যত প্রজন্ম বোধহয় চার দেওয়ালেই ‘বন্দি’ হয়ে যাবে।
ছবি: মধুমিতা মজুমদার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy