দুর্ঘটনার পরে ভিড়। চলছে দেদার কয়লা কুড়োনোও।
প্রহরীবিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে দশ চাকার ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কায় দুমড়ে গেল ট্রেনের ইঞ্জিন। কপাল জোরে প্রাণে বাঁচলেন চালক।
বুধবার সকাল সাতটা নাগাদ বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথের কামনাড়া স্টেশনের কাছে ঘটনাটি ঘটে। রেল সূত্রে জানা গিয়েছে, কাটোয়া-বর্ধমান রেলপথের ওই যাত্রীবাহী ট্রেনটি বলগনা থেকে বর্ধমানের দিকে আসছিল। বলগনা থেকে সকাল ছটা বেজে দশ মিনিটে ট্রেনটি ছাড়ে। কামনাড়া স্টেশনে পৌঁছয় ছটা পঁয়তাল্লিশ নাগাদ। তার মিনিট পাঁচেক পরেই স্টেশনের কাছে পালিতপুরের একটি প্রহরীবিহীন লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় একটি দশ চাকার কয়লাবোঝাই ট্রাকের ডানপাশে ধাক্কা মারে ট্রেনটি। ট্রাকটি উল্টে যাওয়ায় ওই লাইনে কিছুক্ষণ ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। তবে মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে লাইন পরিষ্কার করা হয়েছে বলে রেলের দাবি। রেলের তরফে জানানো হয়েছে, বর্ধমান থেকে আরেকটি ইঞ্জিন পাঠিয়ে দুর্ঘটনাগ্রস্থ ট্রেনটিকে বর্ধমানে নিয়ে আসা হয়। তারপরেই ফের ওই রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে যায়। যাত্রীদের কেউ হতাহত হননি।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, একদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিধ্বস্ত ট্রাকটি। ট্রাকের সামনের দিকটি সোজা থাকলেও ট্রেনের ধাক্কায় পিছন দিকটি চুরমার হয়ে গিয়েছে। রেললাইন ও আশপাশে প্রচুর কয়লা ছড়িয়ে রয়েছে। পুলিশের সামনেই স্থানীয় মানুষ সেই কয়লা কুড়িয়ে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। পুলিশ জানিয়েছে, পালিতপুরে বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে। তার একটিতেই কয়লা নিয়ে যাচ্ছিল ওই ট্রাকটি। দুর্ঘটনার পর থেকেই অবশ্য ট্রাক চালকের খোঁজ মেলেনি।
ক্ষতিগ্রস্থ ইঞ্জিনটি।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ট্রাকটি ইঞ্জিনটিকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ২০০ গজ এগিয়ে গিয়েছিল। ধাক্কায় ইঞ্জিনের সামনের বেশ খানিকটা ভেঙেও যায়। তবে দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে বুঝেই ট্রেনের চালক একপাশে সরে যান বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি। অন্যথায় ইঞ্জিনটি যেভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে, তাতে চালকের প্রাণহানিও হতে পারত। রেল সূত্রে জানানো হয়েছে, ওই চালকের নাম শের সিংহ। পায়ে চোট পেয়েছেন তিনি। তাঁকে প্রথমে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ও পরে কলকাতায় এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে রেলের সিনিয়র সেকশন ইঞ্জিনিয়ার চন্দন গড়াই বলেন, “ওই দুর্ঘটনার পিছনে ট্রেন চালকের কোনও দোষ আমরা প্রাথমিক তদন্তে অন্তত পাচ্ছি না। ট্রাক চালকের তাড়াহুড়োর পরিণতিতেই ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে। লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে ওই ট্রেনটির গতিও খুব কম ছিল। তাই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। এমনকী ট্রেনটি লাইনচ্যুতও হয়নি।” তবে গতি কম থাকা সত্বেও কেন চালক দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ট্রেন থামাতে পারলেন না সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান চন্দনবাবু। তবে এক ট্রেনযাত্রী, কর্জনা চটির বাসিন্দা মহম্মদ হানিফের দাবি, “ট্রেন আর ট্রাকের মধ্যে কে আগে লাইন পার হবে তা নিয়ে রেষারেষি চলছিল। ট্রাকটি প্রায় লাইন পার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ট্রেন চালক সময়মতো ব্রেক না কষায় দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
কয়েকবছর আগেই বর্ধমানের ওই রেললাইন ন্যারোগেজ থেকে ব্রডগেজে পরিণত হয়। তবে তার আগেও ওই রেলপথের প্রায় সমস্ত লেভেল ক্রসিং প্রহরীবিহীন ছিল। এখনও পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি। আগে লাইনে গরু বসে থাকলেও চালককে ট্রেন থেকে নেমে গরু তাড়িয়ে ট্রেন চালাতো হত। অনেকক্ষেত্রে তো দু’দিক থেকে আসা যানবাহনের স্রোত ঠেকিয়ে নিজেদেরই লেভেল ক্রসিংয়ের গেট বন্ধ করতে হত। এখন ভোল পাল্টালেও লেভেল ক্রসিংয়ে প্রহরী মোতায়েন যে হয়নি তা পালিতপুরের ঘটনা আরও একবার দেখিয়ে দিল।
বর্ধমান রেল স্টেশন সূত্রের খবর, বর্ধমান থেকে বলগনার মাঝে মোট ৯টি স্টেশন রয়েছে। তারমধ্যে ৬ টিতেই প্রহরী নেই। পালিতপুরের ওই লেভেল ক্রসিংয়ে মাসখানেক আগেই বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছিল বর্ধমানের কমলপুরের বাসিন্দা মহম্মদ মিলাতউল্লাহের। তার কয়েকদিন আগে ট্রেনে কাটা পড়ে দুটি গরু। বছরখানেক আগে ট্রেন-ট্রাকের ধাক্কায় রেল লাইন ভেঙে বেশ কিছুদিন ট্রেন চলাচল বন্ধও ছিল।
ওই এলাকার বাসিন্দা শেখ হারাদুল, মিলন দাস, পূর্ণচন্দ্র দত্তদের অভিযোগ, “বারবার এই পালিতপুর লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। আমরা বারেবারে রেলের কাছে প্রহরী মোতায়েন করার দাবি জানালেও, লাভ হয়নি। এমনকী লেভেল ক্রসিংয়ের দু’পাশে সিগন্যাল বসানোরও ব্যবস্থা হয়নি।” তাঁদের দাবি, এর জেরেই বারবার দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মতো ঘটনা ঘটছে।”
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি মেনে নিয়েছেন বর্ধমানের স্টেশন ম্যানেজার স্বপন অধিকারী। তিনি বলেন, “ওই এলাকার বাসিন্দারা আমাদের চিঠি লিখে লেভেল ক্রসিংয়ে প্রহরী মোতায়েন করার দাবি জানিয়েছিলেন। আমরা তা রেলের পদস্থ কর্তাদের জানিয়েছি। তবে এ দিন দুর্ঘটনার পিছনে ট্রাক চালকের দোষ ছিল। সিগন্যাল না থাকলেও, ওই লেভেলক্রসিং-এর দু’পাশে দেখা যায়। ট্রেনের চালক হর্ন দিতে দিতেই এগোচ্ছিলেন। ট্রাক চালকের উচিত ছিল থেমে যাওয়া। তিনি তা না করায় দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy