দখলে আসানসোল। শুক্রবার শহরের রাস্তায়। ছবি: শৈলেন সরকার।
তিন বছর আগে ঘাসফুলে ছয়লাপ হওয়া দুর্গে লাগল নতুন রঙ।
বিধানসভা ভোটে বড় বড় ব্যবধানে জিতে আসার পরে জয়ের ব্যাপারে অনেকটাই নিশ্চিত ছিল তৃণমূল। ২০১১ সালে যে সব এলাকা তারা দখল করেছিল হেলায়, আসানসোল লোকসভা কেন্দ্রের সেই সব এলাকায় এ বার তছনছ ঘাসফুল। আর তৃণমূল-বিজেপির ভোট কাটাকাটিতে হারানো জমি ফেরত ও আসন ধরে রাখার আশায় থাকা বামেদের হাল হল তাসের ঘরের মতো।
২০১১ সালে নিজেদের জেতা বিধানসভাগুলির কোনওটিতে এ বার ২৫ হাজার, কোথাও ২১ হাজার, কোথাও আবার প্রায় ৪০ হাজার ভোটে পিছিয়ে পড়ে বিজেপি-র কাছে পরাস্ত হল তৃণমূল। একমাত্র মুখরক্ষা পাণ্ডবেশ্বর, তিন বছর আগে যে বিধানসভায় তারা হেরেছিল। আর আড়াই দশক টানা দখলে রাখা এই কেন্দ্রে জেতা তো দূর, এ বার দ্বিতীয় স্থানও পেল না সিপিএম। গত বার যেখানে তারা প্রায় ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার ভোট পেয়েছিল, এ বার তা দাঁড়াল ২ লক্ষ ৫৫ হাজারে।
কেন এমন পরিস্থিতি হল? মুখ খুলতে নারাজ তৃণমূল নেতারা। তবে দলের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রার্থী বহিরাগত বলে দলের অনেকে গোড়া থেকে প্রচারের মাঠে সর্বশক্তি দিয়ে নামতে চাননি। এ ছাড়া সাংসদ হলে দোলা সেন এডিডিএ-র চেয়ারম্যান হতে পারতেন। খনি-শিল্পাঞ্চলের রাজনীতি ও অর্থনীতির রাশ এলাকার নেতা বা নেত্রী নন, এমন কারও হাতে যাক, তা দলের একাংশ চায়নি বলেই খবর। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল বাবুলের বিরুদ্ধে তৃণমূলের আনা অস্ত্র আইনে মামলা বা মদ্যপ অবস্থায় মন্দিরে ঢোকার অভিযোগ। যাতে দিনের জনতার সহানুভূতি বাবুলের পক্ষে গিয়েছে বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ।
এই লোকসভা কেন্দ্রের নানা এলাকায় দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও এ বারের ভোটে তাঁদের বিপক্ষে গিয়েছে বলে মনে করছেন কয়েক জন তৃণমূল নেতা। সামনেই আসানসোল ও কুলটির পুরভোট। তার আগে এই ধাক্কা কী ভাবে সামাল দেওয়া যায়, এখন সে দিকেই নজর তৃণমূলের। হারের পরে শুক্রবার দোলা সেন বলেন, “কেন এমন হল, তা অনুসন্ধান করব। আমার এবং আমাদের কোথায় ত্রুটি, তা খুঁজে বের করতে হবে।”
২০০৯ লোকসভা ভোট পর্যন্ত এই কেন্দ্রে সিপিএমের জয়ের পিছনে বড় ভূমিকা নিয়ে এসেছে রানিগঞ্জ, জামুড়িয়া ও পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা এলাকার ভোট। গত বার এখানে সিপিএমের বংশগোপাল চৌধুরী জিতেছিলেন প্রায় ৭২ হাজার ভোটে। ওই তিন বিধানসভা এলাকা থেকেই তিনি এগিয়েছিলেন প্রায় ৯৮ হাজার ভোটে। সেখানে এ বার এক মাত্র জামুড়িয়ায় ‘লিড’ পেয়েছেন সিপিএম প্রার্থী বংশগোপালবাবু, তা-ও মাত্র ২৬৩ ভোটে। পাণ্ডবেশ্বরে তিনি রয়েছেন দ্বিতীয় স্থানে, তৃণমূলের থেকে ৯৭০৭ ভোটে পিছিয়ে। আর রানিগঞ্জের ভূমিপুত্র বংশগোপালবাবু নিজের এলাকায় রয়েছেন তৃতীয় স্থানে, বাবুল সুপ্রিয়ের থেকে প্রায় ১৬ হাজার ভোট কম পেয়ে।
গত বারও আসানসোল উত্তর, কুলটি, বারাবনিতে পিছিয়ে ছিল সিপিএম। কিন্তু এ বার ধস আরও গভীর হয়েছে। ২০০৯-এ আসানসোল দক্ষিণে সিপিএম প্রার্থী এগিয়ে থাকলেও ২০১১ সালে ওই বিধানসভা যায় তৃণমূলের দখলে। সেই এলাকায় এ বারও সিপিএমের ভরাডুবি হয়েছে। ২০১১ সালে আসানসোল কেন্দ্রের অন্তর্গত পাণ্ডবেশ্বর ও জামুড়িয়া বিধানসভা আসন দু’টি ব্যবধান কমলেও বামেরা দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এ বার সেই পাণ্ডবেশ্বরও হাতছাড়া হওয়ার ইঙ্গিত।
ইঙ্গিতটা মিলেছিল গত পঞ্চায়েত ভোটের সময়েই। জামুড়িয়া ও পাণ্ডবেশ্বরএই দুই ব্লকে একটি করে পঞ্চায়েতে ক্ষমতা দখল করতে পেরেছিল বামেরা। তার আগে দুই জায়গাতেই সব পঞ্চায়েত ছিল বামেদের দখলে। ভোটপর্বে দুই এলাকাতেই ছাপ্পা, রিগিং, সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল। পাণ্ডবেশ্বর ও জামুড়িয়ায় সিপিএম এবং তৃণমূলদুই সূত্রেই জানা গিয়েছে, দু’পক্ষই আশায় ছিল, বিজেপি অন্য পক্ষের ভোট কাটবে, আর তাতে লাভের কড়ি আসবে তাদের পকেটে। কিন্তু সেই পকেট বিজেপি এ ভাবে কেটে যাবে, কল্পনায় আনেনি তারা।
লালদুর্গে টিমটিম করে জ্বলে শুধু জামুড়িয়া। নিভেছে বাকি সব দেউটি। কেন এই পরিস্থিতি? বংশগোপালবাবু শুধু বলেন, “বিজেপি বিপুল ভোট পাওয়ায় আমরা আসন ধরে রাখতে পারলাম না। কেন এই পরিস্থিতি হল, পর্যালোচনা করে দেখতে হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy