Advertisement
০২ মে ২০২৪

স্কুলের সামনে বোমা-গুলি, তবু বই হাতে অদম্য পড়ুয়ারা

বোমা-গুলির আওয়াজ এ এলাকার বাসিন্দাদের কাছে জলভাত। রাতের পর রাত পুলিশের ভারি বুটের শব্দের সঙ্গে ঘুমের আপোস করে নিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা? বোমা-গুলি-বুটের শব্দে অভ্যস্ত হলেও দু’দণ্ড বইয়ে মন দেওয়ার জো ছিল না তাদের। অষ্টপ্রহর কোনও না কোনও গোলমালের এ জায়গার নাম মঙ্গলকোটের লাখুরিয়া। তবে এ রকম পরিবেশেও মাধ্যমিক পরীক্ষায় জেলার শিরোনামে উঠে এসেছে এ গ্রাম।

যশোদানন্দন গোস্বামী উচ্চ বিদ্যালয়। নিজস্ব চিত্র।

যশোদানন্দন গোস্বামী উচ্চ বিদ্যালয়। নিজস্ব চিত্র।

সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৪ ০১:০৬
Share: Save:

বোমা-গুলির আওয়াজ এ এলাকার বাসিন্দাদের কাছে জলভাত। রাতের পর রাত পুলিশের ভারি বুটের শব্দের সঙ্গে ঘুমের আপোস করে নিয়েছেন তাঁরা।

কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা? বোমা-গুলি-বুটের শব্দে অভ্যস্ত হলেও দু’দণ্ড বইয়ে মন দেওয়ার জো ছিল না তাদের। অষ্টপ্রহর কোনও না কোনও গোলমালের এ জায়গার নাম মঙ্গলকোটের লাখুরিয়া। তবে এ রকম পরিবেশেও মাধ্যমিক পরীক্ষায় জেলার শিরোনামে উঠে এসেছে এ গ্রাম। ব্যক্তিগত নম্বরের ভিত্তিতে নয়, এখানকার যশোদানন্দন গোস্বামী (জেএনজে) উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫২ জন পড়ুয়াই এ বছর মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছে।

শুধু এ বছর নয়, গত কয়েক বছর ধরেই লাখুড়িয়ার জেএনজে উচ্চ বিদ্যালয়ের সাফল্যের হার একশো শতাংশ। স্কুল সুত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালে ৫৬ জন, ২০১১ সালে ৫২ জন, ২০১৩ সালে ৪৬ জন পড়ুয়া মাধ্যমিকে দিয়েছিল। সবাই উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১২ সালে ৪৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৪৮ জন উত্তীর্ণ হয়েছিল। পড়ুয়ারা ও তাদের অভিভাবকেরা এক বাক্যে জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সব সময় আতঙ্কে ভোগেন বাসিন্দারা। তবুও স্কুল চলছে তার নিজের নিয়মেই।

ষাটের দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় এই স্কুলটি। প্রথমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল, পরে ১৯৬৩ সালে স্কুলটি মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়। এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত করারও অনুমোদন এসেছে। কিন্তু শিক্ষকের অভাবে উচ্চ মাধ্যমিক চালু করা যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষের মধ্যে।

পুলিশ জানিয়েছে, লাখুরিয়া স্কুল থেকে কয়েক হাত দূরে অজয়। ও পারে বীরভূমের নানুর। দিনে দুপুরে স্কুলের সামনের মাঠে ছাত্র-শিক্ষকদের সামনেই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বোমা-গুলির লড়াই হয়েছে। পুলিশের গাড়ি আটকানোর জন্য স্কুলের কাছে মোরাম রাস্তা কেটে দিয়েছে দুষ্কৃতীর দল। কোটালঘোষের এক অভিভাবক বলেন, “ভাত খেয়ে দল বেঁধে বাড়ির ছেলেরা স্কুলের উদ্দেশে বেরিয়েছে। এমন সময় মাঠের মধ্যে বোমাবাজি শুরু হয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন দিন এ রকম ঘটনায় বাড়ির ছেলে মেয়েরা অভ্যস্ত। সে জন্য তাঁদের স্কুল যেতে ভয় লাগত না।” অনেক পড়ুয়া জানিয়েছে, ভয় লাগত না ঠিকই, তবে মূর্হুমুহু বোমার আওয়াজে পড়া হত না। তারপর পুলিশের গাড়ি কিংবা ভারি বুটের আওয়াজে আতঙ্কে ভুগতাম আমরা। তবে স্কুলের উপর কোনও দিন ওই সব গোলমালের প্রভাব পড়েনি বলে শিক্ষকদের দাবি। ফলে স্কুলও কোনও দিন বন্ধও রাখতে হয়নি।

কিন্তু টানা সাফল্যের ‘রহস্য’টা কী?

স্কুল সূত্রে জানা যায়, টেস্ট পরীক্ষার পরেও পড়ুয়াদের ‘স্টাডি লিভ’ দিতেন না প্রধান শিক্ষক মদনমোহন চৌধুরী। শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য ‘বিশেষ ক্লাসের’ ব্যবস্থা করতেন তিনি। ওই স্কুলের সদ্য প্রাক্তন শিক্ষক শরদিন্দু ঘোষ বলেন, “প্রধান শিক্ষকের কথা মতো মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের নম্বরের ভিত্তিতে তিনটে পর্যায়ে ভাগ করা হয়। প্রয়োজন মতো তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। যেমন, ইংরেজি ও অঙ্কের জন্য প্রতিদিন এক ঘন্টার বিশেষ ক্লাস নেওয়া হয়।” মদনমোহনবাবুও বলেন, “মেধাবী ও নিম্নমেধাবী পড়ুয়াদের জন্য পৃথক ভাবে ক্লাস নেওয়া হয়। ফলে পড়ুয়াদের কখনও ইতস্তত লাগে না। শিক্ষকেরাও পড়ুয়াদের প্রতি সজাগ থাকতে পারেন।”

ওই স্কুলের এ বারের কৃতী রাহুল বৈরাগ্য কিংবা ঐকান্তিকা দত্তরা বলে, “প্রথমেই সমস্ত পড়ুয়াদের মানসিকতা মজবুত করেন শিক্ষকরো। তা ছাড়া সারা বছরই টিফিনের সময় আমাদের সব সমস্যা হাসিমুখে সমাধান করে দেন। ফলে টেস্ট পরীক্ষায় ‘কম নম্বর’ পাওয়া পড়ুয়ারাও মাধ্যমিকে গিয়ে পাশ করে যায়।” এলাকার শিক্ষানুরাগী চিকিৎসক অরূপ গোস্বামী বলেন, “অন্য স্কুলের মতো ওই স্কুলে সব পড়ুয়াকেই টেস্টে পাশ করানো হয় না। প্রধান শিক্ষকের কঠোর মনোভাবই স্কুলে সাফল্যনিয়ে আসছে।” এলাকার এক তৃণমূল নেতা বিপিন কৈবর্তও বলেন, “অন্য জায়গার মতো আমরা স্কুলের ব্যাপারে কোনও খবরদারি করি না।” প্রধান শিক্ষক বলেন, “শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অভিভাবক, পরিচালন সমিতি সবাইকে নিয়ে আমাদের একটা পরিবার। আর এই পরিবারের সবচেয়ে জরুরি সদস্য আমার পড়ুয়ারা। তাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই আমাদের উদ্দেশ্য।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

soumen dutta katwa lathuria mangalkot
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE