Advertisement
E-Paper

পরিষেবাহীন জনশূন্য ওয়ার্ড ছাড়ছেন রোগীরা

ঠিক মতো পরিষেবা জুটছিল না। তার উপরে ফাঁকা ওয়ার্ডে একা থাকার ‘ভয়’ ধরেছিল হাওড়ার আন্দুলের সৌমি কাঁড়ারের মনেও।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৯ ০১:৫৯
এন আর এসে ফাঁকা মেডিসিন ওয়ার্ড (বাঁদিকে), ছুটি করিয়ে নাতনিকে নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়ছেন বদরুন্নিসা বিশ্বাস(মাঝখানে), ফাঁকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাড়ির পথে সৌমি কাঁড়ার(ডানদিকে)। শনিবার। ছবি: সৌরভ দত্ত ও রণজিৎ নন্দী

এন আর এসে ফাঁকা মেডিসিন ওয়ার্ড (বাঁদিকে), ছুটি করিয়ে নাতনিকে নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ছাড়ছেন বদরুন্নিসা বিশ্বাস(মাঝখানে), ফাঁকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে বাড়ির পথে সৌমি কাঁড়ার(ডানদিকে)। শনিবার। ছবি: সৌরভ দত্ত ও রণজিৎ নন্দী

কোথাও সময়ের আগেই চিকিৎসকেরা ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন রোগীদের! কোথাও আবার ঠিক মতো পরিষেবা তো জোটেইনি, উপরন্তু থাকতে হচ্ছে ফাঁকা ওয়ার্ডে। সেই আতঙ্কে নিজেরাই ছুটি নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াচ্ছেন বহু রোগী। রাজ্য জুড়ে পাঁচ দিন ধরে চলা চিকিৎসকদের কর্মবিরতির জেরে শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলির পরিস্থিতি এখন এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছে।

ঠিক মতো পরিষেবা জুটছিল না। তার উপরে ফাঁকা ওয়ার্ডে একা থাকার ‘ভয়’ ধরেছিল হাওড়ার আন্দুলের সৌমি কাঁড়ারের মনেও। আর তাই শনিবার বিকেলে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ছুটি লিখিয়ে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময়ে ওই তরুণী বললেন, ‘‘ওয়ার্ডে আমি ছাড়া আর মাত্র এক জন ছিলেন। আস্তে আস্তে সকলেই চলে যাচ্ছেন। ফাঁকা ঘরে একা থাকতে রীতিমতো ভয় করছিল। আর কোনও চিকিৎসকই তো কথা শুনছেন না। কিছু বলতে গেলে ওঁরা বলছেন, বাড়ি চলে যাও।’’ চার দিন ভর্তি থাকলেও পাঁচটি ইঞ্জেকশন ছাড়া মেয়ের তেমন কোনও চিকিৎসাই হয়নি বলে অভিযোগ সৌমির বাবা স্বপন ভুঁইয়ার। মেয়েকে নিয়ে ট্যাক্সি ধরার আগে তিনি বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরাই তো আসছেন না ঠিক মতো দেখতে। শুধু শুধু ফেলে রেখে কী হবে? তাই নিয়ে যাচ্ছি।’’

ঠিকঠাক চিকিৎসা না পাওয়ায় নাতিকে ছুটি করিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছেন দারাপাড়ার বাসিন্দা তসলিমা বেগমও। দিন চারেক আগে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল জ্বরে আক্রান্ত সেই এক বছরের শিশু। এ দিন তার ঠাকুরমা বলেন, ‘‘ঠিক মতো তো কেউ দেখছেন না। জ্বর একটু কমতেই তাই ছুটি লিখিয়ে নিলাম।’’ আগের কয়েক দিনের মতো এ দিনও ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সব ক’টি গেট বন্ধ ছিল। মূল গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন জুনিয়র চিকিৎসক ও নিরাপত্তারক্ষীরা। কোনও রোগী এলে আগে তাঁদের কাছে কাগজপত্র দেখাতে হচ্ছে। চিকিৎসকেরা কাগজপত্র দেখে যদি মনে করেন, তবেই রোগী জরুরি বিভাগ পর্যন্ত যেতে পারছেন।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগে ভর্তি থাকা, মুকুন্দপুরের বিভা মণ্ডলের দাবি, চিকিৎসকেরা তাঁকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তবেই আবার আসতে বলেছেন। তা‌ই এ দিন বিকেলে হাসপাতাল থেকে ছুটি লেখানোর পরে বোন মিতা বিশ্বাসের সঙ্গে বাড়ি যাওয়ার জন্য হাসপাতালের সামনের বাসস্টপে বসে ছিলেন তিনি। মিতাদেবী বলেন, ‘‘গত সপ্তাহে দিদিকে ভর্তি করেছিলাম। কয়েক দিন ধরেই ডাক্তারবাবুরা বলছেন, বাড়ি নিয়ে যান। সব মিটে গেলে আবার আসবেন। তাই ছুটি করিয়ে নিলাম।’’ পাঁচ বছরের নাতনি মেহের খাতুনকে নিয়ে ফাঁকা হাসপাতালে থাকতে ভয় করছে বলে জানালেন উলুবেড়িয়ার বদরুন্নিসা বিশ্বাস। তাই নাতনির পায়ে অস্ত্রোপচার হওয়ার পরে ছুটি লিখিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছেন তিনি। বললেন, ‘‘হাসপাতালের গেট বন্ধ। বাড়ির অন্য লোকেরা ঠিক মতো ঢুকতে পারছেন না। পরে আবার সব ঠিক হয়ে গেলে দেখাতে আসব।’’

ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মতোই এ দিন সব গেট বন্ধ ছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। একটিমাত্র গেট খোলা থাকলেও তা আগলে ছিলেন জুনিয়র চিকিৎসক ও নিরাপত্তারক্ষীরা। সেই গেট থেকেই শ্বাসকষ্টে ভোগা ছেলেকে নিয়ে ফিরে যেতে হয়েছে বলে অভিযোগ আমতার বাসিন্দা সজ্জু জুহাইদ আলির পরিজনদের। শেষে তাঁরা এসএসকেএম হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলে সেখানে ওই শিশুকে ভর্তি নেওয়া হয়। কিন্তু বহির্বিভাগ বন্ধ থাকায় সমস্যায় পড়তে হয়েছে অন্য অনেক রোগীকে। তবে যে সকল রোগীর অস্ত্রোপচার জরুরি, কর্মবিরতির মধ্যে তা-ও করেছেন চিকিৎসকেরা।

যেমন, কবরডাঙার রামচন্দ্রপুরের যুবক দীপঙ্কর মণ্ডল এ দিন এসএসকেএমের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চেক-আপ করাতে এসেও ফিরে গিয়েছেন খালি হাতে। গত শনিবার ওই হাসপাতালেই অস্ত্রোপচারে তাঁর ডান পায়ের দু’টি আঙুল বাদ যায়। দীপঙ্করের দাদা জয়দেব বলেন, ‘‘প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের পাঁচতলায় গিয়ে দেখলাম, কেউ নেই। দোতলায় এসে চিকিৎসকদের বললাম। ওঁরা বললেন, পারলে অন্য জায়গায় দেখান।’’ বারাসতে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মোটরবাইক দুর্ঘটনায় গুরুতর চোট পাওয়া শামসুর শেখ ও ফতেমা বিবিকে এ দিন এসএসকেএমে আনা হলে তাঁদের জরুরি পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। আর তাঁদের পাঁচ বছরের ছেলে শাহিদ ইমাম শেখের ফেটে যাওয়া মাথা সিটি স্ক্যান করিয়ে পরীক্ষা করেছেন চিকিৎসকেরা।

অ্যাম্বুল্যান্সে বসে মাসির কাছে রুটি খেতে খেতে শাহিদ বলে, ‘‘ডাক্তারবাবুকে আমি বললাম, বাবা-মাকে ভাল করে দাও। ডাক্তারবাবু আমার গোঁফ এঁকে দিল।’’ ছোট্ট ছেলেটার কথা শুনে কার্যত জনশূন্য হাসপাতালের ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা লোকজনের আক্ষেপ, ‘‘কর্মবিরতি উঠে কবে যে সব আবার এমন স্বাভাবিক হবে!’’

Doctor's Strike NRS Hospital Violence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy