মেজাজে: বোলপুরের বাড়ি থেকে সিউড়ির পথে। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
সাতসকালে কলকাতা থেকে বোলপুর হয়ে সিউড়ি, শেষ বিকেলে ফের কলকাতা। হাতেগোনা আসনে ভোট হলে কী হবে, দিনভর সিউড়িতে বসে ভোট পরিচালনা করে তবে জেলা ছাড়লেন বীরভূম তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত (কেষ্ট) মণ্ডল।
নির্বাচনের মুখে কেষ্টর হুঁশিয়ারি ছিল, ভোটের দিনেও ‘উন্নয়ন’ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে। দিনের শেষে বিরোধী নেতারাও একান্তে মানছেন, মনোনয়ন-পর্বে শাসকদলের যে দাপট ছিল— ভোটের দিনে এলাকা আগলানোর ততটা তাগিদ ছিল না। তবে জেলার ময়ূরেশ্বর থেকে মল্লারপুর, মহম্মদবাজারের নানা প্রান্তে বিচ্ছিন্ন গোলমালের খবর এসেছে। কোথাও ব্যালট বাক্স লুঠ, তো কোথাও ছাপ্পার অভিযোগ। বোমাবাজিও হয়েছে মহম্মদবাজারের ভূতুড়া পঞ্চায়েতের মৌলপুর, পুরাতন গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়।
তবে সে সবের দায় নিতে চাননি অনুব্রত। তাঁর কথায়, ‘‘খুব ভাল ভোট হয়েছে। জেলার ১৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১৯টি পঞ্চায়েত সমিতির সব ক’টি আসনে তো বটেই মঙ্গলকোট, কেতুগ্রামেও সব আসনে জিতব।’’ গোলমাল প্রসঙ্গে তাঁর জবাব, ‘‘যেখানে যা অশান্তি, করেছে সব বিজেপি। ওঁদের কোনও সংগঠন নেই, জনসংযোগ নেই। কী ভাবে ভোট করতে হয় জানে না। তাই এমন করেছে।’’ তা শুনে বিজেপির জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় বলছেন, ‘‘একাধিক বুথ দখল হয়েছে, রাজনগর, মহম্মদবাজারের বিভিন্ন বুথে দেদার ছাপ্পা পড়েছে। মহম্মদবাজারের মৌলপুরের বুথে থেকে তো ব্যালট বাক্সই নিয়ে পালিয়েছে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা।’’
ভোটের সকালে বোলপুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, পৌঁনে দশটায় বাড়ি ঢুকে কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে গায়ে গন্ধ মেখে ঘরের দেওয়ালের সার দেওয়া দেবতাদের উদ্দেশে প্রণাম সেরে অনুব্রত দশটা পঁচিশ নাগাদ বেড়িয়ে যান সিউড়ির তৃণমূলের কার্যালয়ের দিকে। সেখান থেকে শেষ বিকেল পর্যন্ত ভোটের তদারকি করে গিয়েছেন তিনি। তার পরই ছুটতে হয়েছে কলকাতায়। দলের নেতাকর্মীরা বলছেন, ‘‘বৌদি (অনুব্রতর স্ত্রী ছবিরানি) দীর্ঘ দিন ধরে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। কলকাতায় চিকিৎসাধীন। তাই এত ছোটাছুটি করতে হচ্ছে দাদাকে।’’ তবে বৌদির অসুস্থতাজনিত উৎকণ্ঠা সত্বেও দাদা রাজনৈতিক পেশাদারিত্বে কোনও খামতি রাখেননি।
তৃণমূল সূত্রের খবর, এ দিন সকাল পৌঁনে এগারোটা নাগাদ সিউড়ি কার্যালয়ে পৌঁছেই দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে গল্পে মজেন অনুব্রত। পাশে জেলা সহ সভাপতি অভিজিৎ সিংহ, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী, বিধায়ক অশোক চট্টোপাধ্যায়, গদাধর হাজরা, সিউড়ির উপপুরপ্রধান বিদ্যাসাগর সাউ, একাধিক কাউন্সিলর অন্য নেতারা। ফরমায়েস করেন, ‘খুব খিদে পেয়েছে। বাটার টোস্ট আর চা নিয়ে আয়।’ জলযোগ শেষে ফের শুরু হয় আড্ডা। ফাঁকে ফাঁকেই মহম্মদবাজার, রাজনগর, ময়ূরেশ্বরের বিভিন্ন বুথে কেমন ভোট হচ্ছে খবর নিয়ে গিয়েছেন অনুব্রত। একের পর এক ফোন ঘুরিয়ে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন ব্লক সভাপতিদের। কোথাও কোনও গোলমাল নেই তো? ঘুরে-ফিরে একই জিজ্ঞাসা। ময়ূরেশ্বর থেকে একটা ফোন আসার পরে অনুব্রতকে বলতে শোনা যায়, ‘‘কিচ্ছু করার প্রয়োজন নেই। যা হয় হোক। শাসকদল সন্ত্রাস করেছে, এটা যেন শুনতে না হয়।’’ বেলা সাড়ে ১২টা থেকে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা আসতে শুরু করেন। তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বেলা দুটো নাগাদ দু’টো রুটি, লাউয়ের তরকারি, দই, শসা সহযোগে মধ্যাহ্নভোজ সারেন। দলের কর্মীরা বলছেন, ‘‘আগাগোড়াই খোসমেজাজে ছিলেন দাদা।’’
মনোনয়ন পর্ব মেটার পরেই ভোটের দিন রাস্তায় ‘উন্নয়ন’ দাঁড়িয়ে থাকবে বলে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি। পরে অবশ্য সংবাদমাধ্যমে অনুব্রত দাবি করেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে জেলায় নানা উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। রাস্তাঘাট থেকে পানীয় জল, আবাস যোজনা থেকে ক্ষুদ্রসেচ সমস্ত কিছুতেই জেলা এগিয়ে। পর পর দু’বার কেন্দ্রীয় সরকারের পঞ্চায়েত গ্রামোন্নয়ন দফতরের দীনদয়াল উপাধ্যায় স্বশক্তিকরণ পুরস্কারও পেয়েছে।’’
সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা বলছেন, ‘‘সব কাজ তো উনি ভোটের আগেই সেরে রেখেছেন। যেটুকু বাকি ছিল, সেটা পূরণ করতে দেদার ছাপ্পা হয়েছে। খোজমেজাজ উনি ছাড়া আর কেই বা থাকবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy