পান চাষের সুবিধা হল, বহুবর্ষজীবী হওয়ায় বারবার লাগানোর খরচ নেই। পাঁচ-ছ’দিন অন্তর পান পাতা তুলে বাজারে বিক্রি করা যায় বছরভর। ঠিক যেন পকেটের মানিব্যাগ—যখন দরকার, ঝাড়লেই পয়সা। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে পান চাষ হলেও গুণগত মানের দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পান সেরা। এই রাজ্যের প্রায় সমস্ত জেলাতেই পান চাষ হয়। তবে, যেখানে বেলে-দোঁয়াশ মাটি রয়েছে, সেখানেই ভাল পান হয়। মাটির পিএইচ ৭ কিংবা তার বেশি দরকার।
মাটি তৈরি: পান বহুবর্ষজীবী হওয়ায় মাটি তৈরিতে সতর্কতা নিতে হয়। উঁচু জমিতে জল নিকাশির সুবন্দোবস্ত যেন থাকে। জমিকে ভাল ভাবে চাষ দিয়ে রোদ্দুরে এক মাস ফেলে রাখতে হবে। এতে মাটিতে রোগজীবাণু ও আগাছার বীজ মরে যাবে। মাটি লাঙল দিয়ে বা পাওয়ার টিলারে চাষ দিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
বরজ তৈরি: পানের বরজ তৈরির সরঞ্জাম গ্রামেই পাওয়া যায়। পাট কাঠি, হোগলার ডাঁটা পাতা, উলু ঘাস, খড়, গাছের ডাল, বাঁশ, খেজুর গাছের পাতা ইত্যাদি দিয়ে ছোট ছোট চাল বানিয়ে নিতে হয়। এর পর পান জমির চারদিকে বাঁশ দিয়ে খুঁটি পুঁতে চালগুলিকে দাঁড় করিয়ে দিতে হয়। বরজের উপরেও চালগুলি ঢেকে দিতে হয় যাতে হাওয়া, আলো না ঢুকতে পারে। না হলে পানে পোকার উপদ্রব হয়। বরজে পানের ডাঁটা হাতখানেক লম্বা হলেই বাঁশের খুঁটি দিয়ে পানের ডাঁটা বা লতাগুলিকে বেঁধে দিতে হয়। যে খুঁটি ধরে তরতরিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে পান গাছ। এই খুঁটিগুলো বরজ তৈরির সময় বসিয়ে নিতে হবে। বরজের উচ্চতা ২ মিটার হলেই ভাল। এর কম উচ্চতা হলে বরজের ভিতর চলাফেরায় অসুবিধা হয়। একটু খরচা করে আধুনিক স্থায়ী কাঠামো বানিয়ে পান চাষ করতে পারলে ভাল হয়।
চারা রোপণ: বরজের ভিতর উত্তর দিক বরাবর ৫০-৬০ সেমি দূরত্বে লাইন করতে হয়। লাইনে ১ বোর্দো মিশ্রণ প্রতি বর্গমিটারে তিন লিটার হারে স্প্রে করে দিতে হবে। ৫-৬ দিন পর পানের ডাঁটা এনে ব্লাইটস্কে শোধন করে রিং করে ১০-১৫ সেমি দূরত্বে বসিয়ে জল দিতে হবে। এর পর মাটি ঢাকা দিয়ে দিতে হবে। খুব গরমকাল বাদ দিলে সারা বছরই ডাঁটা লাগানো যায়। তবে, বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে লাগালে গাছের বাড় ভাল হয়। ৪-৫ বছরের বরজ থেকে পানের ডাঁটা বা লতা নির্বাচন করতে হয়।
পরিচর্যা: পান গাছ রোগ সুবেদী বলে ঘন ঘন ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। ১০-১৫ দিন অন্তর ০.৪% ব্লাইটক্স পানের ডাঁটায় স্প্রে করতে হয়। দু’আড়াই মাসের ব্যবধানে পান গাছ বরজের মাথা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেলে তাকে নামিয়ে খুঁটি বরাবর ছুঁইয়ে মাটির উপরে নিয়ে আসতে হবে এবং পানের লতাকে সুতো দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। তবে নীচের দিকের পানের পাতা যাতে মাটি না স্পর্শ করে সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। নইলে রোগপোকা বাড়বে। মাঝেমধ্যে বরজে সেচ দিতে হবে। গ্রীষ্মকালে ৮-১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। সেচ দেওয়ার সময় গোড়ার মাটি সরে গেলে রোগপোকামুক্ত মাটি দিয়ে আবার ঢেকে দিতে হবে।
সার: বছরে বিঘা প্রতি ২৪ কেজি নাইট্রোজেন, ১০ কেজি ফসফরাস এবং ৩৬ কেজি পটাশ প্রয়োগ করতে হয় প্রতি বোরজে। এই পরিমাণ খাবার দিতে হলে ৪ কুইন্ট্যাল সর্ষে খোল, ৫২ কেজি ইউরিয়া, ৬০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং ৬৪ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ দিতে হবে। সর্ষে খোল বাজারে না পাওয়া গেলে বাদাম খোল, নিম বা তিল খোলও দেওয়া যেতে পারে। এই পরিমাণে সার চার-পাঁচ বারে ভাগ করে প্রয়োগ করতে হবে। গাছের অণুখাদ্যের জন্য ট্রাসেল-২ (প্রতি লিটারে ৬ গ্রাম) দেওয়া হয়।
পান তোলা: নতুন বরজে তিন থেকে চার মাসের মাথায় পান তোলা শুরু করা যেতে পারে। পাঁচ-ছয় দিন অন্তর পাতা বোঁটা সমেত তুলতে হবে। প্রথম বছরে একটি বরজ থেকে যে পান পাতা পাওয়া যাবে, দ্বিতীয়-পঞ্চম বছরে তার অনেক বেশি মিলবে। এই ভাবে বছর ছয়েক চলবে। মোটামুটি এক বিঘা বরজে প্রতি বছর হাজার চল্লিশেক টাকা লাভ থাকে।
লেখক: বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy