লোকগীতির আসর চলছে ঘুড়িষায়। নিজস্ব চিত্র।
চর্চা চলে বছরভরই। কিন্তু অনুষ্ঠানের ডাক মেলে কই!
বরং দম ফেলার ফুরসৎ মেলে না ফি বছর এই মনকেমনের শরৎ এলে। পুজোর সময় থেকেই পর পর মাস দু’য়েক বায়না উড়ে আসে পড়শি গ্রাম, পাশের জেলা থেকে। মিঠে লোকসুরে মেতে উঠে চণ্ডীমণ্ডপ। পুজোতলা। ফুটবল ময়দান। সন্ধে রাতেই আসর ঘিরে বসে পড়েন পাড়া-ঘর। কালো মাথার ভিড়ে জমজমাট ইলামবাজারের আনন্দগোপাল দাস ও সম্প্রদায়দের লোকগীতির আসর। এই লক্ষ্মীপুজোর বাজারেও ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালির সুরেই রাত মাতাচ্ছেন তাঁরা।
এলাকার পায়ের গ্রামের আদিবাসিন্দা তথা পাঁচড়া হাইস্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক আনন্দবাবু ওঁদের দলের শুরুর গল্প বলছিলেন। লোকগীতির আসর নিয়ে এই দুর্গাপুজোর মরসুমে, এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপ কার্যত ছুটে যেতে হয় তাঁকেই। এলাকাতেও বিশেষ কদর রয়েছে ওই দলের। আসলে স্বল্প খরচে, বিভিন্ন স্বাদের এই লোকগীতির অনুষ্ঠান সচরাচর কেউ হাতছাড়া করতে চান না। আনন্দবাবুর ছোট বেলার নেশা লোকগীতি। কিন্তু সেই অর্থে ছোট বেলায় সে পথে আর যাওয়া হয়নি। বছর পাঁচেক আগে, তিনি ফের লোকগীতি চর্চা শুরু করেছেন। মধ্য পঞ্চাশের আনন্দবাবুর উদ্যোগেই দল গড়ে ওঠে।
কেমন সেই দল?
ছয় সদস্যের দল। কেউ দিন মজুরি করেন তো কেউ চাষবাসের কাজ। এমনই পাঁচ সদস্যকে নিয়ে, লোকগীতির দল গড়েছেন আনন্দবাবু। পাঁচড়ার কাছে বাঘাসোলের বাসিন্দা তারাশঙ্কর বাগদী এবং নাবোড়সোলের চার বাসিন্দা অমৃত দাস, উদয় দাস, বলরাম দাস ও সনৎ দাসকে নিয়ে দল গড়েছেন আনন্দবাবু। আনন্দবাবুর কেউ সমবয়সী তো কেউ প্রাক্তন ছাত্র। কারও হাতে তবলা তো কেউ বাজায় কি বোর্ড। কেউ গান তৈরি করেন আবার কেউ দোতারাতে সুর তোলেন। কেউ গাবগুবি নিয়ে মাতিয়ে তোলেন অনুষ্ঠান মঞ্চ। ঝুমুর, মুর্শিদি থেকে শুরু করে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মারফতি— নানা লোকসুরে ভাসে রাত। আছে বাউল ও ফকির গান থেকে লালনগীতির সম্ভারও। শ্রোতাদের কথায় মঞ্চে মঞ্চে ঝড় তুলছেন তাঁরা।
আনন্দবাবু বলছিলেন, ‘‘নিজে স্কুল কামাই করি না, বা দলের কাউকে নিজেদের কাজকর্ম ছেড়ে আসতে বলি না। আর দলের অন্য সদস্যেরা নিজদের দিন মজুরি ও চাষবাসের কাজকর্ম ছেড়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন না। তা বলে, রেওয়াজে একদিন দাঁড়ি পড়বে, তা অবশ্য মানতে পারেন না দলের কোনও সদস্য। দৈনিক অবসরে চুটিয়ে চলে রেওয়াজ।’’
সম্প্রতি ইলামবাজারের ঘুড়িষা কার্যত মাতিয়ে তুলল তাঁর দল। ইলামবাজারের ঘুড়িষা-গঙ্গাপুরের প্রশান্ত মুখোপাধ্যায়দের পারিবারিক দুর্গাপুজো আড়াই দশক ধরে কোনও এক কারণে বন্ধ আছে। গ্রামে পুজো হবে না, মানতে পারছিলেন না গ্রামেরই অনেক বাসিন্দারা। আর তাই গ্রামে চেয়ে চিন্তে সর্বজনীন পুজো করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।
গঙ্গাপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসব হয়ে আসছে গত ২৪ বছর ধরে, জানাচ্ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা তথা কমিটির সম্পাদক সাধনকুমার মুখোপাধ্যায়। সে পুজোতে একাদশী এবং দ্বাদশীর দিন লোকগীতির প্রথা আজও চলে আসছে।
বর্ধমান জেলার বনকাঠি অযোধ্যা উচ্চ বিদ্যালয়য়ের বাংলা ও সংস্কৃতের শিক্ষক সাধনবাবু জানান, ‘‘লোকগানের প্রথা আজও সমান আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। তাই এলাকায় বিশেষ ভাবে নামকরা আনন্দগোপাল দাস ও সম্প্রদায়ের কাছে খবর পাঠিয়ে ছিলাম। তাঁরা আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়েছেন। লোকগীতির অনুষ্ঠান আয়োজন হয়।’’
ইতিমধ্যেই আনন্দগোপাল দাস ও সম্প্রদায় ৬৭টি গান নিয়ে আসরে নামে। ইতিমধ্যে ৮টি গানের অডিও ভিডিও সিডিও প্রকাশিত হয়েছে দলের। জেলার মণ্ডপে কিংবা মহরমেও জনপ্রিয় তাঁদের লোকসুর। ঘুড়িষা গঙ্গাপুর মঞ্চেই শোনা গেল তাঁদের গান, ‘‘এই বাংলার বারোমাসে তেরোটা উৎসব। ঈদ, মহরম আর পুজোয় সাজো সাজো রব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy