দার্জিলিঙের রাস্তায় পুড়ে যাওয়া গাড়ি। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
সিংমারিতে বাজারহাটের ভিড়ে বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। নির্জন, নিশ্চুপ।
এখানেই নর্থ পয়েন্ট স্কুল। তার পাশ দিয়ে যে রাস্তা খাড়াই পাকদণ্ডীর মতো নেমে গিয়েছে, তার শেষ কোথায়?
ড্রাইভার সাহেব আদম বললেন, এই পথ সিকিমের সিংটামে গিয়েছে। কিন্তু আমাদের গন্তব্য তার অনেক আগে। পাতলেবাস। আরও খানিকটা নীচে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্কুল। যে পাতলেবাসে আজ তালা। সেটা ‘তাঁর’ বাড়িতেই হোক, বা দরবারে। একই রকম সুনসান ‘তাঁর’ কাঞ্চনজঙ্ঘা স্কুল। চত্বরে দাঁড়িয়ে একটি স্কুলবাস। কিন্তু আর কেউ নেই চারধারে। না পড়ুয়া, না শিক্ষক। ‘‘সকলকে জানুয়ারির পরে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদের টিসি দেওয়া হয়েছে। তারা এখন অন্য স্কুলে চলে গিয়েছে,’’ বলছিলেন উপেন্দ্র, মন দিয়ে জুতো সেলাই করতে করতে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই পথ পেরিয়ে আসতে দেখা হয়েছে একাধিক কঙ্কালের সঙ্গে। গাড়ির কঙ্কাল। একটি সিংমারিতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার পুরনো পার্টি অফিসের আগে। যেটি দেখতেই ঝলকে উঠল ২০১৭ সালের ১৭ জুনের স্মৃতি। সে দিন দু’দিক থেকে দু’টি মিছিল এসে প্রায় ঘিরে ফেলেছিল রাজ্য পুলিশ বাহিনীকে। মোর্চার অভিযোগ ছিল, এই দুই মিছিলকে সামলাতে পুলিশ যে গুলি চালায়, তাতে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও রাজ্য গুলি চালনার কথা অস্বীকার করেছিল।
সে দিনের সেই পোড়া গাড়ি এখনও পড়ে আছে সিংমারিতে মোর্চা পার্টি অফিসের আগে। পড়ে আছে পাতলেবাসে, তাঁর বাড়ির আগে। তার পরেও পাকদণ্ডী বেয়ে যদি নেমে যান, দেখবেন, তাকভর চা বাগানের সুনসান রাস্তা। দেখবেন তাঁর দরবার ঘরের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মুখে গ্রিলের দরজায় বড় তালা। আর সিঁড়িতে শ্যাওলা জমে আছে। দেখবেন, তাঁর বাড়িতে ঢোকার মুখে নোটিসের পরে নোটিস টাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছে প্রশাসন। দেখবেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা স্কুলে একে একে খসে পড়ছে হোর্ডিংয়ের অক্ষর। যে পাহাড়ে এক সময়ে তাঁর কথায় সূর্য উঠত, অস্ত যেত বলে বিশ্বাস সেখানকার মানুষের, সেই পাহাড়ে তিনি কোথাও নেই।
তিনি বিমল গুরুং। রবিবার পাতলেবাসের পথে ঘন কুয়াশা। খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে নামার সময়ে প্রতি বাঁকে চালকের সতর্কতা মনে করিয়ে দিচ্ছিল বছর কয়েক আগের কথা। তাঁর দরবারে হাজির হতে রীতিমতো গাড়ির লাইন পেরোতে হয়েছিল এই দুর্গম পথেও। তিনি এসে বসেছিলেন যে চেয়ারে, তার পিছনের দরজায় লেখা: হিমালয় কি রানি। কুয়াশা ঠেলে যাওবা এগোনো গেল, কিন্তু কোথায় কী! যে বাড়ির সামনে লাইন পড়ত বছর দেড়েকে আগে, সেই পথে এখন ক্বচিৎ এক-আধটা মোটরবাইক দেখা যায়। তাঁর দরবারের উল্টো দিকে যে রেশন দোকান ছিল, তাতেও তালা। বিমল কি ফিরবেন? মন দিয়ে নিজের কাজ করতে করতে উপেন্দ্র বলেন, ‘‘সে তো মামলা চলছে।’’ এখানকার লোক কি চাইছে? তিনি বলেন, ‘‘বলা মুশকিল মানুষের মনে কী আছে।’’
দরবার ঘরের উল্টো দিকে থাকেন রবীন গুরুং। মোটরবাইকে চেপে কাজে বার হচ্ছিলেন। বিমলকে মনে পড়ে? বললেন, ‘‘ও তো রাজনৈতিক নেতা পরে। আগে গ্রামের ছেলে।’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘গ্রামের ছেলেকে কী ভাবে ভুলি!’’
কুয়াশা পেরিয়ে তখন উপত্যকায় রোদ-ছায়ার খেলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy