পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের বাকি আর বছর দেড়েক। আর এই সময়টুকু জুড়ে সে রাজ্যকেই তাঁদের পয়লা লক্ষ্য হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই লক্ষ্যপূরণের রণকৌশল হিসেবে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকেই প্রচারের সব চেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন তাঁরা।
লোকসভা ভোটের প্রচারে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে অনুপ্রবেশ নিয়ে সরব হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তৃণমূলের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে বলেছিলেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশ থেকে যাঁরা বেআইনি ভাবে ভারতে এসেছেন, তাঁদের ফেরত পাঠানো হবে। শনিবার, দশমীর দিনে সঙ্ঘপ্রধানের বার্ষিক বক্তৃতায় বার বার তিন বার দেশের পূর্বাঞ্চলে অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ তুলেছেন মোহন ভাগবত।
দূরদর্শনে সরাসরি সম্প্রচারিত বক্তৃতায় পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে অনুপ্রবেশের প্রসঙ্গ তুলে সরসঙ্ঘচালকের বক্তব্য, এর ফলে এই সব অঞ্চলে শুধু যে জনবিন্যাসের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, তাই নয়। আইনশৃঙ্খলার উপরে তার প্রভাব পড়েছে এবং তা দেশের নিরাপত্তার পক্ষেও বিপজ্জনক হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই ‘নির্বাচনী ফায়দার জন্য তোষণের রাজনীতি’রও কড়া সমালোচনা করেছেন ভাগবত।
বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে বিজেপি এবং সঙ্ঘ নেতৃত্বের সরব হওয়াটা মোটেই নতুন নয়। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পায়ের তলার মাটি পাওয়ার পরে এবং সদ্যসমাপ্ত বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন একার জোরে জিতে নেওয়ার পরে বিষয়টি অন্য মাত্রা পাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-কে ক্ষমতাসীন করাটা যে তাঁর লক্ষ্য, সেটা আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আগেই ঘোষণা করেছেন দলীয় সভাপতি অমিত শাহ। বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, অনুপ্রবেশ নিয়ে সরব হওয়াটা তাঁর রণকৌশলের অঙ্গ। সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচার যেমন চলছে, তেমন চলবে। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্ত-লাগোয়া বসিরহাটে জয়, অনুপ্রবেশ নিয়ে অবস্থান আরও কড়া করার ব্যাপারে দলকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
গত ২ তারিখ দুর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরক তৈরির গোপন কারখানায় বিস্ফোরণ এবং প্রাথমিক তদন্তে বাংলাদেশের জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে দুষ্কৃতীদের যোগাযোগ প্রমাণিত হওয়াটা অনুপ্রবেশ নিয়ে তাদের প্রচারকে প্রাসঙ্গিক করে তুলবে বলেই বিজেপি নেতাদের অভিমত।
মহারাষ্ট্রের ভোট মিটলেই নতুন অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে কলকাতা সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অমিত শাহ। তার আগে পশ্চিমবঙ্গের অনুপ্রবেশ সমস্যা নিয়ে নাগপুরে মোহন ভাগবতের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন তিনি। আরএসএস নেতা তথা অধুনা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবকেও এ ব্যাপারে একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছে। অমিত শাহ বলেন, “অনুপ্রবেশ পশ্চিমবঙ্গ, অসম-সহ বিস্তৃত পূর্বাঞ্চলের জনসংখ্যার চরিত্রটিই বদলে দিয়েছে। অনুপ্রবেশকারীরা তো ভারতীয় নাগরিক নয়! তা হলে তারা ভিসা ছাড়া এ দেশে থাকবেন কোন যুক্তিতে? পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে কি এটা সম্ভব?” অমিত জানান, বিজেপি এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে চায়। কারণ এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
আর রাম মাধব বলেছেন, “অনুপ্রবেশের বিষয়টি নিয়ে যে আমরা আজ হঠাৎ প্রচার অভিযান শুরু করেছি, এমন নয়। সেই ১৯২৫ সালে আরএসএসের জন্মলগ্ন থেকেই তারা এ নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।”
তা হলে ২০১৪ সালের শেষ লগ্নে মোহন ভাগবতদের প্রচার কৌশলের নতুনত্ব কী?
বিজেপি সূত্র বলছে, লালকৃষ্ণ আডবাণী থেকে মুরলী মনোহর জোশী অনুপ্রবেশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বারবার সরব হয়েছেন। কিন্তু ঘটনা হল, ১৯৮৯ সালে রাম মন্দির আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গোবিন্দাচার্যের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটা পৃথক অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছিলেন আডবাণী। তখন অনুুপ্রবেশকে অগ্রাধিকার না দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র-রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের ভাবনাচিন্তাকে তুলে ধরে এক ধর্মনিরপেক্ষ-হিন্দু বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রচার করতে চেয়েছিলেন বিজেপি নেতারা।
আর এনডিএ আমলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না-থাকায় অনুপ্রবেশ নিয়ে সে ভাবে সরব হতে পারেনি বিজেপি। যদিও বিষয়টি ঘিরে উদ্বেগ ছিল যথেষ্টই। রাষ্ট্রপতি ভবনে রাজ্যপাল সম্মেলনে গোপাল গাঁধীর মতো ব্যক্তিত্ব মন্তব্য করেছিলেন, অনুপ্রবেশের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ‘ঘুমন্ত ডিনামাইট’ হয়ে উঠেছে। অসমের প্রাক্তন রাজ্যপাল এ এন সিন্হা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আডবাণীকে এক রিপোর্টে বলেছিলেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের জন্য অসমের জেলাওয়াড়ি জনসংখ্যার চরিত্র বদলে যাচ্ছে।
শরিকি চাপের মুখে বাজপেয়ী, আডবাণীকে যে আপস করতে হয়েছিল, মোদী-অমিত শাহকে সেটা করতে হচ্ছে না। তাই অনুপ্রবেশ নিয়ে এ বার খোলাখুলি ময়দানে নামছেন তাঁরা। অমিত শাহ মনে করেন, অতীতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কখনও কোনও নির্বাচনে অনুপ্রবেশকে বড় বিষয় বলে গ্রহণ করেননি। ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি যারা করে, তাদের প্রভাবে এ রাজ্যের মানুষ মনে করেছেন,
এটি একটি ধর্মীয় বিষয় এবং এ থেকে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয়। কিন্তু এ বার তিনি অনুপ্রবেশের বিপদকে এ রাজ্যের মানুষের সামনে তুলে ধরতে চান। অমিতের কথায়, “তৃণমূল কংগ্রেস তথা অন্য কিছু দল ধর্মীয় মেরুকরণ করছে, যাদের ধারণা অনুপ্রবেশ নিয়ে সরব হলে তারা সংখ্যালঘু ভোট হারাবে!”
পশ্চিমবঙ্গের মোট ভোটারের প্রায় তিরিশ ভাগ মুসলিম। একদা সিপিএম এই ভোটের বড় দাবিদার ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ভোটারদের তৃণমূলের বাক্সে আনতে সক্ষম হয়েছেন। এখন এই ভোটবাক্সের দখল নিয়ে ফের সিপিএম-কংগ্রেস-তৃণমূলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিন্হার অভিযোগ, মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক রক্ষার স্বার্থেই অনুপ্রবেশ নিয়ে নরম মনোভাব দেখাচ্ছে তৃণমূল। যার জবাবে রাজ্যের মন্ত্রী ববি হাকিমের মন্তব্য, “বিজেপি রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, জম্মুতেও ওরা এই কাজই করছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সনাতন সংস্কৃতির ভিত মজবুত। ওঁরা এখানে সফল হতে পারবেন না।”
সঙ্ঘ নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছেন, বিজেপি সংখ্যালঘু ভোট পাবে না ঠিকই, কিন্তু রাজ্যে শতকরা সত্তর ভাগ হিন্দু ভোটের প্রধান দাবিদার তারা হয়ে উঠতেই পারে। একই সঙ্গে নিজেদের মুসলিম-বিরোধী প্রতিপন্ন করে বাঙালি শিক্ষিত সমাজের উদার মানসিকতাতেও আঘাত দিতে চায় না তারা। পাশাপাশি অনুপ্রবেশের বিপদ নিয়ে প্রচার চালালে শিক্ষিত, উদার ভোটদাতাদের সমর্থন মিলবে বলেই আশাবাদী বিজেপি নেতারা। তাঁদের মতে, রাজনীতির গণ্ডি ছাপিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটিও বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যা জাতীয়তাবাদী সব মানুষকেই ভাবাবে।
অনুপ্রবেশকে অস্ত্র করে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আশার আলোই দেখছে বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy