কলকাতার একটি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে সরফুদ্দিন আলি আহমেদ। — ফাইল চিত্র।
দলেরই এক নেতার একের পর এক বিপজ্জনক অবৈধ নির্মাণের প্রতিবাদে শ’পাঁচেক তৃণমূল কর্মী থানা ঘেরাও করেছেন। পুলিশের কাছে জমা পড়েছে বাসিন্দাদের প্রতিবাদপত্রও। তার পরেও প্রশাসন বিন্দুমাত্র হেলদোল না-দেখানোয় এ বার শুরু হয়েছে দফায় দফায় থানা ঘেরাও।
মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ এই নেতার দাপটে পুলিশ নিষ্ক্রিয় বলে অভিযোগ উঠেছে শাসক দলের নিচু তলায়। পুরো বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনতে এলাকার বাসিন্দারা মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও প্রতিবাদপত্র জমা দিয়েছেন। তাতেও বন্দর এলাকায় অবৈধ নির্মাণ কোনও ভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না— এই অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের অন্দরেই। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠানো চিঠিতে কলকাতা পুরসভার ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা লিখেছেন, শুধু আইন ভাঙা নয়, যে সব বহুতল ওই এলাকায় তৈরি হচ্ছে সেগুলি প্রত্যেকটিই বিপজ্জনক। একটু বেশি মাত্রার ভূমিকম্পেই ওই সব বাড়ি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা।
এই সব অবৈধ নির্মাণে অভিযোগের আঙুল উঠেছে রাজ্যের নগরোন্নায়ন মন্ত্রী তথা বন্দরের বিধায়ক ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ঘনিষ্ঠ ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল নেতা সরফুদ্দিন আলি আহমেদের দিকে। এলাকার এক বাসিন্দার অভিযোগ, ‘‘আমরা একবালপুর থানায় অভিযোগ জমা দিয়ে কোনও সাড়া পাইনি। তাই পুলিশের বড় কর্তাদের কাছেও চিঠি পাঠিয়েছি। তাতেও কোনও সাড়া তো মেলেইনি, উল্টে সরফুদ্দিন নতুন নতুন বেআইনি বাড়ি তৈরি করে যাচ্ছে। প্লাস্টিক ঢাকা দিয়ে দিন-রাত চলছে সরফু-র এই সব অবৈধ নির্মাণ।’’
লালবাজারের এক পুলিশ কর্তার কথায়, একবালপুরের সরফু হল প্রতাপ নম্বর-টু। আলিপুর থানায় ভাঙচুর ও পুলিশ কর্মীদের মারধরের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন ফিরহাদ ঘনিষ্ঠ প্রতাপ সাহা। কিন্তু মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ প্রতাপের টিকিও ছুঁতে পারেনি পুলিশ। চার্জশিটে নাম ওঠেনি সরফুর। প্রতাপ আগাম জামিন নিয়ে বহাল তবিয়তে থানার আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। আলিপুরের ঘটনার পর প্রকাশ্যে মন্ত্রী প্রতাপকে কয়েক মাস এ়ড়িয়ে চলছেন। কিন্তু ওই মামলার চার্জশিট আদালতে জমা পড়ার পর ফের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতাপ ও মন্ত্রীকে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছে।
বন্দর বিধানসভা কেন্দ্রে ফিরহাদ-ঘনিষ্ঠ সরফু একের পর এক অবৈধ নির্মাণ করার পরও পুলিশের মুখে টুঁ শব্দটি নেই বলে অভিযোগ তুলেছেন ওই ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি নাসিরউদ্দিন জামাল। নাসিরউদ্দিনের কথায়, ‘‘খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। ঘিঞ্জি এলাকায় কোনও নিয়মের তোয়াক্কা না করেই অবৈধ নির্মাণ চলছে। একটু জোরে মাটি কাঁপলেই ওই সব বাড়ি ভেঙে পড়বে। তখন কী হবে, সেই চিন্তায় রাতের ঘুম চলে গিয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।’’ শুধু ৭৮ নম্বর ওয়ার্ডেই মোমিনপুর রোড, একবালপুর লেন, ভূকৈলাস রোড, ময়ুরভঞ্জ রোড, ডেন্টমিশন রোড-সহ বিভিন্ন এলাকায় পুরসভার অনুমোদন ছাড়াই ওই সব অবৈধ নির্মাণ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। একেবারে বড় রাস্তার ওপরই ওই অবৈধ নির্মাণকাজ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ সরফুর দাপটে পুলিশ একেবারে চুপ।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এলাকার বাসিন্দারা ও স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকটি অবৈধ নির্মাণকাজ স্বচক্ষে দেখে এসেছেন কিছু পুলিশ-কর্তা। বন্দর এলাকার পুলিশের এক বড় কর্তার কথায়, ‘‘আমরা দেখে তো এসেছি! কিন্তু নানা সমস্যা রয়েছে। ঝটপট কিছু করতে গেলেই বিপদ।’’
তবে অবৈধ নির্মাণের সঙ্গে তিনি কোনও ভাবেই জড়িত নন বলে দাবি করছেন সরফু। তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন শাসক দলের এই নেতা। এলাকার বাসিন্দাদের কথায়, সরফু খুবই প্রভাবশালী ব্যক্তি। এলাকায় মুখ্যমন্ত্রীর কোনও অনুষ্ঠান থাকলে তিনি মঞ্চে থাকবেনই। মন্ত্রীর নির্দেশে অনুষ্ঠান পরিচালনার সব দায়িত্ব তিনিই পালন করেন। সরফুরও দাবি, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের খুবই ঘনিষ্ঠ। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের এক জনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে তিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ভবানীপুর এলাকায় ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অফিসে তাঁর নিত্য যাতায়াত রয়েছে বলেও দাবি করছেন সরফু।
তৃণমূলের ওপরতলায় সরফুর যোগাযোগ যে পোক্ত, তার প্রমাণ পেয়েছেন একবালপুর লেন-র বাসিন্দা ইউসুফ খান। তাঁর বাড়ির উল্টো দিকে একটি ভগ্নপ্রায় দোতলা বাড়ির উপর আরও দু’টি তলা গাঁথার কাজ শুরু করেছে সরফুর লোকজন। পুরনো বাড়ির উপর নতুন গাঁথনির চাপে যখন-তখন তা ভেঙে পড়তে পারে বলে আশপাশের বাড়ির বাসিন্দারা আতঙ্কিত। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, পুলিশ-প্রশাসন-পুরসভা সব জায়গায় অভিযোগ জানিয়েও কোনও প্রতিকার হয়নি। তার পর মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেও অভিযোগ জানিয়েছেন ওই এলাকার তৃণমুল কর্মী বলে পরিচিত ইউসুফ। মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে অভিযোগ জানানোর পর প্রায় মাস খানেক হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকেও কোনও সাড়া-শব্দ আসেনি। সরফুর নির্মাণ কাজ চলছে দিন রাত।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, ওই এলাকায় অবৈধ নির্মাণে কোটি টাকার ব্যবসা। পুরসভার কোনও অনুমোদন নেই। প্রতি বর্গফুট প্রায় সাড়ে-চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। জল ও বিদ্যুতের বেআইনি সংযোগ। ওই সব অবৈধ নির্মাণে নিম্ন মানের বালি-সিমেন্ট-পাথর ব্যবহার করা হচ্ছে। নজর এড়াতে তাড়াহুড়ো করে তৈরিও করা হয়। সে ক্ষেত্রে যখন-তখন ওই সব বাড়ি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়।
বন্দর এলাকার পুলিশের এক বড়কর্তা বলেছেন, ‘‘আমরা অভিযোগ খতিয়ে দেখেছি। ওই নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা হচ্ছে। তার পর উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা হবে।’’ কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। বরো ও কাউন্সিলরদের কাছ থেকে খবর নেব, কী ভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি হল। পরিস্থিতি বিপজ্জনক হলে নিশ্চয়ই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’’ পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বলেন, ‘‘সরফুদের তো পরিবহণের ব্যবসা বলে জানি। ও যে প্রমোটার তা তো জানি না! আমার ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করে কেউ যদি বেআইনি কাজ করে তার দায় আমি নেব না। আইন আইনের পথে চলবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy