দুই কেন্দ্রেই আশির ঊর্ধ্বে! বিপুল ভোট পড়ল রাজ্যের একটি লোকসভা ও বিধানসভা উপনির্বাচনে। সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া শেষ খবর অনুযায়ী, বনগাঁ লোকসভা কেন্দ্রে ভোটের হার ৮২%! কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রেও তা-ই। তখনও আরও কিছু মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে। তাই শেষ পর্যন্ত ভোটের শতাংশ হিসেব আরও বেড়ে যাওয়ারই কথা!
ভোটযন্ত্রের ‘সিল’ খোলার আগে ভোটের এই হারই আপাতত জল্পনা জিইয়ে রাখছে রাজ্য রাজনীতিতে! উপনির্বাচন মানেই সেখানে সাধারণ মানুষের উৎসাহ কম থাকবে, এটাই দস্তুর। সেখানে দুই কেন্দ্রেই একেবারে সাধারণ নির্বাচনের মতো ভোট দেওয়ার ঢল তা হলে কীসের ইঙ্গিত? বর্তমান পরিস্থিতিতে বিপুল হারে ভোট মানে আসলে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতারই সূচক, এমনই মনে করছে বিরোধীরা। তাদের মতে সারদা-কাণ্ডে শাসক দলের একের পর নেতা-মন্ত্রীর জড়িয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অপশাসনে বিরক্ত মানুষই উপনির্বাচনে সরকারকে বার্তা দিতে ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছেন।
পাশাপাশি শাসক দলের মধ্যে আবার চোরা উদ্বেগ, নিজেদের কর্মীদের ‘ভোট করানো’র আড়ালেই চুপচাপ কোনও অঘটন ঘটে যায়নি তো? সামান্য কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া বিরোধীরাও উপনির্বাচনে বিশেষ অভিযোগ করেনি। যা থেকে আরও সন্দেহ এবং উৎকণ্ঠা দানা বাঁধছে শাসক শিবিরের অন্দরে! তা হলে কি ‘বিভীষণে’রাই বাজিমাত করে গেল?
প্রকাশ্যে শাসক দলের দাবি অবশ্যই অন্য রকম। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “বেশি ভোট পড়েছে বলে আমরা উদ্বিগ্ন হব কেন? মানুষ আসলে মরিয়া ছিলেন। কিছু সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধীরা মিলে কুৎসা এবং অপপ্রচার করে যে অবস্থা তৈরি করেছিল, তাতেই মানুষ বেরিয়ে এসেছেন। তাঁরা মনে করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিপদে ফেলা মানে রাজ্যের বিপদ। তাই তাঁরা জবাব দিতে এসেছেন!”
উপনির্বাচন সচরাচর শাসক দলের পক্ষেই রায় দেয়। এ রাজ্যে তার উদাহরণও আছে ভূরি ভূরি। বিরোধীদের চিরকালীন অভিযোগ, উপনির্বাচনে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলায় না। ভোটের পরেও একই সরকার, একই প্রশাসন থাকবে এই পরিস্থিতিকে নিপুণ কায়দায় মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য ব্যবহার করে শাসক দল। কিন্তু এ রাজ্যের বিরোধীরা বলছে, এখনকার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। আগের মতো সবাইকে ‘দাবিয়ে রেখে’ ভোট করার জায়গায় আর নেই শাসক দল। প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহও শাসক দলের বিরুদ্ধে জনমনে নতুন নতুন ক্ষোভের উপাদান জোগাচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের কথায়, “বিধানসভায় এলাকাভিত্তিক ভোটের শতাংশের হিসেব এখনও আসেনি। কিন্তু সাধারণ ভাবে বিপুল ভোট পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ভোটের হার শাসক দলের জন্য চিন্তার কারণই হওয়ার কথা!” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ আরও এগিয়ে বলেছেন, “দুই কেন্দ্রেই মানুষের আশীর্বাদ বিজেপি-র পক্ষে আসবে বলে আশা করছি।” বনগাঁ লোকসভার অন্তর্গত কল্যাণী ও গয়েশপুরে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ ছাড়া ভোট মোটের উপরে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলেই এ দিন রাহুলবাবু মন্তব্য করেছেন।
এ রাজ্যেই অতীতের নজির বলছে, উপনির্বাচনে সাধারণ মানুষ খুব বেশি সাড়া দেন না। এবং সেই সুযোগে শাসক দল নিজের মতো ‘ভোট করিয়ে নেয়’। যার পরিণতিতে দিনের শেষে ভোটের শতাংশের হার ঊর্ধ্বগামী হয়। বিরোধীদের অভিযোগ থাকে শাসক দলের জবরদস্তির দিকে। এ বার কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত বনগাঁ লোকসভার অন্তর্গত ৭টি এবং কৃষ্ণগঞ্জ মোট ৮টি বিধানসভা কেন্দ্রের কোনও বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জমা পড়েনি! রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক সুনীল গুপ্ত জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনে মোট ৮৭টি অভিযোগ এসেছে। প্রতিটি খতিয়ে দেখা হয়েছে, অধিকাংশেরই সারবত্তা মেলেনি। ভোট চলার সময়ে কোনও গ্রেফতারও হয়নি। তবে নিয়ম ভেঙে সহকারী নিয়ে ভোট দিতে দেওয়ায় কল্যাণীর দু’টি বুথের প্রিসাইডিং অফিসারকে সরিয়ে নতুন অফিসার বসাতে হয়েছে। আর ১২টি বুথে ভোটযন্ত্র বিকল হওয়ায় বদল করা হয়েছে।
বিঘ্ন ঘটেনি।
এই আপাত শান্তি-কল্যাণের নীচেই শাসক শিবিরে উড়ে বেড়াচ্ছে উৎকণ্ঠার মেঘ! তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “সারা দিনে যা ঘটেছে, তা থেকে আলাদা করে আশঙ্কা করার কিছু নেই ঠিকই। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিই তো অন্য রকম। উপরে উপরে সব ঠিক থাকলেও ভিতরে অন্য কিছু ঘটে গিয়েছে কি না, সেটা তো ভোট-গণনার আগে বোঝার উপায় নেই!” দলের মধ্যেই কেউ কেউ উদাহরণ দিচ্ছেন তৃণমূলের জন্মের পরে পরেই লোকসভা ভোটে দমদমের ঘটনার। সে বার ভোটের দিন তৎকালীন শাসক সিপিএমের আচরণে কোনও ‘আস্বাভাবিকতা’ ছিল না। গণনায় সবাইকে অবাক করে সিপিএমের অমিতাভ নন্দীকে হারিয়ে জিতে গিয়েছিলেন বিজেপি-র তপন শিকদার! যে অঘটনে শাসক দলের অভ্যন্তরের ‘হাত’ ছিল বলে পরে মেনেই নিয়েছিল সিপিএম।

এ বারের উপনির্বাচনে যতটুকু যা উত্তেজনা হয়েছে, তার বেশির ভাগই কল্যাণী ও গয়েশপুরে। কল্যাণীতে ৪০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী ও গাড়ির টহলদারি সত্ত্বেও বুথ থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে ছিল তৃণমূলের লোকজন, অভিযোগ করেছে বিরোধীরা। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুলবাবুর অভিযোগ, কল্যাণী এবং গয়েশপুরে তৃণমূল ভোট লুঠ এবং হামলার ‘ঐতিহ্য’ বজায় রেখেছে। ওই দু’টি জায়গার ৫৫টি বুথে সব চেয়ে বেশি গোলমাল হয়েছে। কৃষ্ণগঞ্জে ১২টি বুথে বিক্ষিপ্ত হামলা হয়েছে। বাকি জায়গায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন কমিশন এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। তবে তীব্র নিন্দা করেছেন উপনির্বাচনে রাজ্য পুলিশের ভূমিকার।শহর কল্যাণীতে ভোটের হার ছিল সব চেয়ে কম। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ বার নিষ্প্রভ। কল্যাণী ও তার আশেপাশে তাঁর অনেক অনুগামীও ছিলেন নিষ্ক্রিয়। এমতাবস্থায় দলের অন্য শিবিরকে ভোট ‘ম্যানেজ’ করার বাড়তি দায়িত্ব নিতে হয়েছে বলে তৃণমূলের একটি সূত্রের বক্তব্য। যাঁরা এলাকায় তৃণমূলের সমর্থক বলে পরিচিত নন, তাঁদের অনেককেই বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। যাঁরা সে ভাবে চিহ্নিত নন, তাঁরা ছাড় পেয়েছেন। আবার তৃণমূলের সমর্থক বলে পরিচিত হওয়ায় যাঁরা ধমক-চমকের মুখে পড়েননি, তাঁরা জোড়া ফুলেই ভোট দিয়েছেন কি না, ধন্দ দেখা দিয়েছে দলে!
অবিশ্বাসের হাওয়ায় কোনও কিছুই এখন সম্পূর্ণ স্বস্তিতে রাখছে না শাসক দলকে!