‘পাইয়ে দেওয়া’র রাজনীতিতে জোর ধাক্কা! রাজ্যে পরিষদীয় সচিব নিয়োগের বিতর্কিত আইন বাতিল করে ধাক্কাটা দিল খোদ হাইকোর্ট।
আইন মোতাবেক রাজ্য বা কেন্দ্র কোথাওই সংশ্লিষ্ট আইনসভার মোট সদস্য-সংখ্যার ১৫ শতাংশের বেশি জনকে মন্ত্রী করা যায় না। সেই হিসেবে ২৯৪ বিধায়কের রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গে মন্ত্রী হতে পারেন ৪৪ জন। অথচ শাসক দলে পদপ্রার্থীর সংখ্যা ঢের বেশি। ২০১৩ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার সমতুল পরিষদীয় সচিব পদ তৈরি করেছিলেন, তখনই অভিযোগ উঠেছিল— দলে অসন্তোষ চাপা দিতেই আরও বেশ কিছু বিধায়ককে বেতন, ভাতা থেকে শুরু করে নীল বাতির গাড়ি, আর্দালি, পিএ ইত্যাদি হরেক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। দু’বছরে বাড়তে বাড়তে পরিষদীয় সচিবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩। তৃণমূল-সূত্রেই বলা হচ্ছে, আনুগত্যের মাপকাঠিতে যাচাই করে মুখ্যমন্ত্রী কাউকে যেমন পদে বসিয়েছেন, তেমন কাউকে নামিয়েছেনও। (যেমন, মুকুল রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগে ব্যারাকপুরের বিধায়ক শীলভদ্র দত্তকে সম্প্রতি পদ হারাতে হয়েছে বলে দলীয় সূত্রের দাবি)। কিন্তু যে আইনবলে মুখ্যমন্ত্রী আনুগত্যের পুরস্কার এবং অসন্তোষ ধামাচাপা দিচ্ছিলেন, সেই ‘পশ্চিমবঙ্গ পরিষদীয় সচিব (নিয়োগ, বেতন, ভাতা ও আনুষঙ্গিক নিয়মবিধি) আইন, ২০১২’-এর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সোমবার সেটি খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট।
সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন
গ্রীষ্মাবকাশ শেষে এ দিন হাইকোর্ট খুলতেই প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করে। যা শুনে নবান্ন, বিধানসভা ও তৃণমূল ভবনে শোরগাল পড়ে যায়। রায়ে স্থগিতাদেশ চেয়ে রাজ্যের তরফে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চেই আবেদন জানানো হয়েছিল। বেঞ্চ তা-ও নাকচ করে দিয়েছে। আইনজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, নিয়োগ সংক্রান্ত আইনটিই যে হেতু রদ হয়ে গেল, তাই পরিষদীয় সচিবের পদ বাঁচাতে হলে রাজ্যকে অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্টে স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন দাখিল করে হাইকোর্টের রায়ের উপরে স্থগিতাদেশ চাইতে হবে।
প্রসঙ্গত, সিঙ্গুরের অধিগৃহীত জমি ফেরতের লক্ষ্যে মমতা সরকারের তৈরি আইনও হাইকোর্ট বাতিল করে দিয়েছে সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন তুলে। সেই মামলাও এখন চলছে সুপ্রিম কোর্টে।
এ দিন হাইকোর্টের রায়ের কিছু ক্ষণ বাদে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় পৌঁছন। সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ‘‘আইনজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে।’’— জানান মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক সূত্র। রাজ্যের আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, ‘‘রায়ের প্রতিলিপি হাতে পাইনি। আমরা উচ্চ আদালতে যেতে পারি। আবার আইনের যে যে বিষয়ে হাইকোর্টের আপত্তি, সে সব সংশোধনও করতে পারি।’’
রাজনীতির অঙ্ক কষে ‘পাইয়ে দেওয়ার’ রীতি অবশ্য এ রাজ্যেই একচেটিয়া নয়। আমেরিকা বা অন্যান্য উন্নত দেশে যখন হাতেগোনা মন্ত্রী দিয়েই মসৃণ ভাবে সরকার চলে, তখন এ দেশে এক সময় পুরো-আধা-সিকি মন্ত্রীতে ছয়লাপ ছিল মন্ত্রিসভা। তাদের সুখ-সুবিধার আয়োজনেও ত্রুটি ছিল না। আইন পাল্টে মন্ত্রীর সংখ্যায় লাগাম টানা হলেও বিভিন্ন আধা সরকারি সংস্থার মাথায় রাজনীতির লোকেদের বসিয়ে তাঁদের মানভঞ্জনের চেষ্টায় ভাটা পড়েনি। এই অবস্থায় হাইকোর্টের রায়কে কায়েমি স্বার্থে বড় মাপের ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে।
সেই ধাক্কাকে হাতিয়ার করে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, ‘‘মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী পদের অনেক দাবিদার। (মুখ্যমন্ত্রী) সকলকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। তাই পরিষদীয় সচিব। সাধারণ মানুষের পয়সায় হাতি পোষা!’’ জনগণের টাকায় পরিষদীয় সচিবদের জোগানো যাবতীয় সুবিধা প্রত্যাহার তো বটেই, বিধানসভায় ওঁদের বসার ব্যবস্থাও তুলে দেওয়ার দাবি তুলেছেন বিরোধীরা। এবং সব মিলিয়ে মমতা যে বিলক্ষণ অস্বস্তিতে, তার ইঙ্গিত মিলেছে এ দিনই টাউন হলের এক অনুষ্ঠানে। সেখানে শিল্প-প্রতিনিধিদের সামনে জমির দাম প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে
তাঁর মন্তব্য, ‘‘আদালতই তো এখন সরকার চালাচ্ছে!’’
পদ খুইয়ে হতভম্ব পরিষদীয় সচিবরাও। প্রকাশ্যে অনেকেই অবশ্য বলছেন যে, এ নিয়ে তাঁদের কোনও তাপ উত্তাপ নেই। পরিষদীয় বিষয়ক পরিষদীয় সচিব তাপস রায় যেমন বলেন, ‘‘আমি নিজে পদে বসিনি। আইন যা বলবে, সরকার যা বলবে, তা-ই হবে।’’ প্রাথমিক শিক্ষার পরিষদীয় সচিব পুলক রায়েরও মন্তব্য, ‘‘সরকারি নির্দেশে সচিব হয়েছি। যা করণীয়, সরকার করবে!’’ পূর্তের পরিষদীয় সচিব রবীন্দ্রনাথ ঘোষের বক্তব্য, ‘‘গণতান্ত্রিক রীতি মেনেই আমাদের পদে বসানো হয়েছে মন্ত্রীদের সাহায্য করতে। রাজ্য উচ্চতর আদালতে যাবে। আমাদের চিন্তার কিছু নেই।’’ বস্তুত, একান্ত আলোচনায় অন্য পরিষদীয় সচিবদের অনেকেই বলছেন, এখন ভরসা সুপ্রিম কোর্টই। সেখানে যদি স্থগিতাদেশ মেলে, তা হলে মামলা শেষ হতে হতে ভোট এসে যাবে।
কিন্তু শীর্ষ আদালত যদি স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করে? এক তৃণমূল নেতার আশঙ্কা, ‘‘সে ক্ষেত্রে বিধানসভা ভোটের আগে দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তীব্রতর হবে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও তা ভাল জানেন। তাই সুপ্রিম কোর্টে না-গিয়ে উপায় নেই।’’
রাজ্যের আইনটিকে হাইকোর্ট বাতিল করল কেন? ২০১৩ সালে ওই আইন প্রণয়ন হওয়ার পরেই তার সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থ-মামলা দায়ের করেছিলেন দুই আইনজীবী— বিশাখ ভট্টাচার্য ও পুষ্পল চক্রবর্তী। ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের ব্যাখ্যা দিয়ে বাদীপক্ষের কৌঁসুলি বিকাশ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘সংবিধানের সপ্তম তফসিল অনুযায়ী, পরিষদীয় সচিব নিয়োগের জন্য আইন তৈরির সাংবিধানিক ক্ষমতা রাজ্যের বিধায়কদের নেই। সংবিধান রাজ্যকে প্রশাসনিক পদ তৈরির ক্ষমতা দিয়েছে। পরিষদীয় সচিব প্রশাসনিক পদ নয়।’’ বিকাশবাবু আরও জানান, সংবিধানের ১৬৪ (১এ) ধারা মোতাবেক, কোনও রাজ্যের মন্ত্রিসভার আয়তন বিধানসভার মোট সদস্যের ১৫ শতাংশের বেশি হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে পরিষদীয় সচিবদের প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে মন্ত্রিসভার আকার আদতে তার বেশি করা হয়েছে।
মামলার আবেদনে বলা হয়েছিল, কিছু বিধায়ককে পদ ‘পাইয়ে দেওয়া’র লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ মন্ত্রিসভা আইনটি পাশ করেছে। পরিষদীয় সচিবেরা কার্যত প্রতিমন্ত্রীর সমান মর্যাদা, বেতন ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। জনগণের টাকায় কিছু বিধায়কের পিছনে এ ভাবে টাকা ঢালাকে ‘দুর্নীতি’ হিসেবে অভিহিত করে আবেদনে বলা হয়েছিল, সংবিধান না-মেনে রাজ্য মন্ত্রিসভা সম্পূর্ণ অবৈধ ভাবে আইনটি পাশ করেছে, তাই সেটি বাতিল করা হোক। অপর পক্ষে আদালতে রাজ্যের দাবি ছিল, পরিষদীয় সচিব নিয়োগ ও তাঁদের কাজ ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর রয়েছে, সঙ্গে সচিবদের সরানোর ক্ষমতাও। সরকার এ-ও যুক্তি দেয়, পরিষদীয় সচিবেরা কখনওই প্রতিমন্ত্রী নন, তাঁদের কাজ শুধু বিধানসভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দফতরের সমন্বয়সাধন করা। যার প্রেক্ষিতে আবেদনকারীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘তা হলে দফতরের মন্ত্রীর ভূমিকা কী হবে? পরিষদীয় সচিবের কাজ তো আমলারাই করতে পারেন!’
রাজ্য সরকারের যুক্তি শেষমেশ হাইকোর্টে ধোপে টেকেনি। এ দিন রায় ঘোষণার পরে বিকাশবাবু বলেন, ‘‘পরিষদীয় সচিবদের উচিত, দু’বছর ধরে নেওয়া বেতন ফেরত দেওয়া।’’ আবেদনকারীদের অন্য কৌঁসুলি সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘পরিষদীয় সচিবেরা অবিলম্বে পদ না-ছাড়লে কিংবা সরকার তাঁদের না-সরালে আদালত অবমাননার মামলা করা হবে।’’ আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, ‘‘জনগণের টাকা যে কার্যত লুঠ হচ্ছে, পরিষদীয় সচিব পদ তার অন্যতম প্রমাণ। মু্খ্যমন্ত্রী দলীয় কোন্দল ঢাকতে এক দল বিধায়ককে কিছু পাইয়ে দিচ্ছিলেন। হাইকোর্ট চাতুরিটা ধরে ফেলেছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy