Advertisement
০৫ মে ২০২৪

অশোকের পথে এ বার পুর-যুদ্ধের মুখ অসীম

ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার! কয়েক মাস আগে শিলিগুড়ির পুরভোটের প্রচারে বেরিয়ে হামেশাই এই লাইনটা উদ্ধৃত করতেন অশোক ভট্টাচার্য।

নাম ঘোষণার পরেই প্রচারে অসীম। রবিবার করুণাময়ীতে।—নিজস্ব চিত্র।

নাম ঘোষণার পরেই প্রচারে অসীম। রবিবার করুণাময়ীতে।—নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২১
Share: Save:

ওরে ভীরু, তোমার হাতে নাই ভুবনের ভার!

কয়েক মাস আগে শিলিগুড়ির পুরভোটের প্রচারে বেরিয়ে হামেশাই এই লাইনটা উদ্ধৃত করতেন অশোক ভট্টাচার্য। কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বিধাননগর পুর-নিগমের নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী হিসাবে রবিবার যখন রাজ্যের আর এক প্রাক্তন মন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তের নাম ঘোষণা করল বামফ্রন্ট, তখনও একই কথা বলছেন শিলিগুড়ির মেয়র! অশোকবাবুর কথায়, ‘‘কর্মী-সমর্থকেরা যখন দেখেন বর্ষীয়ান নেতারা তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, লড়াইটা তখন অন্য রকম হয়। নবান্ন অভিযানের দিন থেকে আমাদের আন্দোলন যে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছেছে, তার কারণ নেতাদের সামনে থাকা। এইটাই শিলিগুড়িতে হয়েছিল। আসল কথা হল সাহস। অসীমবাবু সামনে থাকায় এ বার বিধাননগরের লড়াইও জোরালো হবে।’’

বস্তুত, অসীমবাবুকে সামনে রেখেই কলকাতার গায়ের কাছে বিধাননগরে ‘সাহস’ দেখাল সিপিএম। প্রথমত, শিলিগুড়িতে অশোকবাবুকে দিয়ে যে ‘ব্যতিক্রম’ শুরু হয়েছিল, বিধাননগরেও তা অব্যাহত থাকল! চিরাচরিত বাম রাজনীতির প্রথা ভেঙে নির্বাচনের আগেই সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছিল শিলিগুড়িতে। তাতে নির্বাচনী লড়াইয়ে নির্দিষ্ট অভিমুখ পেতে সুবিধা হয়, শিলিগুড়ি থেকে এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে বিধাননগরেও সেই সূত্র প্রয়োগ করা হল। দ্বিতীয়ত, অসীমবাবু নতুন কোনও চমক নন। দীর্ঘ দিন রাজ্যে অর্থমন্ত্রী থাকার সুবাদে বারংবার তৃণমূলের রাজনৈতিক আক্রমণের মুখেও পড়েছেন। তবু ওজনদার কাউকে সামনে রেখে বামেরা লড়াইয়ের ময়দানে আছে— এই বার্তা দেওয়ার জন্যই অসীমবাবুকে বেছে নেওয়া হল। আর তৃতীয়ত, সল্টলেকের সঙ্গে পুরনো রাজারহাট-নিউটাউন এলাকা এ বার নতুন পুরসভার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সিন্ডিকেট এই পুরভোটে চর্চার অন্যতম বড় বিষয়। তৃণমূলের বড-মেজ-ছোট বহু নেতার নাম যেখানে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়়িয়েছে, অসীমবাবুর ভাবমূর্তি সেখানে অন্তত এই সমস্যা থেকে মুক্ত!

বিধানসভা ভোটের অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সঙ্গে সম্মুখ সমরে নেমেছে আলিমুদ্দিন। লাগাতার আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে তারা এখন পথে। আজ, সোমবারই যেমন হকার সংগঠনের আইন অমান্য এবং কাল, মঙ্গলবার বাম ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলির রাজভবন অভিযান ঘোষণা করে বামেরা রাজ্য প্রশাসনকে তটস্থ রেখেছে। এই অবস্থায় বিধাননগরের পুরভোটকে তাঁরা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন, তা বোঝানোর জন্যই এ দিন সল্টলেকে দলের জোনাল দফতরে বসে পুরভোটের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছেন স্বয়ং গৌতম দেব। অসীমবাবু তো বটেই, দলের আর এক প্রাক্তন বিধায়ক রবীন মণ্ডল এবং প্রয়াত মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর পত্নী রমলা চক্রবর্তীকেও পুরভোটে প্রার্থী করে দিয়েছেন সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক। ইতিমধ্যেই কংগ্রেসের অরুণাভ ঘোষ এবং এলাকার বাসিন্দা প্রাক্তন আমলা, প্রাক্তন বিচারপতি-সহ বিশিষ্টদের নিয়ে তৈরি করে ফেলেছেন সল্টলেক ‘সিটিজেন্স ফোরাম’ও। গৌতমবাবু এ দিন বলেছেন, ‘‘এই ভোটটা আমরা অসীমদার নেতৃত্বে লড়ছি। দীর্ঘ দিন তিনি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ভারতবর্ষে অর্থমন্ত্রীদের কমিটিরও তিনিই ছিলেন চেয়ারম্যান। সকলে তাঁকে এক ডাকে চেনেন। তাঁকে সহযোগিতা করবেন রবীন মণ্ডল এবং রমলা চক্রবর্তী।’’

সাংবাদিক বৈঠকে গৌতম দেব। ছবি: শৌভিক দে।

গৌতমবাবু-অরুণাভবাবুদের ওই নাগরিক মঞ্চের ছাতার তলাতেই কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট একসঙ্গে প্রার্থী দেবে, এমন জল্পনা তৈরি হয়েছিল কোনও কোনও মহলে। বামফ্রন্ট প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দেওয়ায় আপাতত সেই জল্পনায় ইতি পড়ল। এই নিয়ে প্রশ্নের জবাবে গৌতমবাবুর বক্তব্য, ‘‘ফোরামের হয়ে প্রার্থী দেওয়া হবে, এই রকম কোনও আলোচনা তো হয়নি! ভারতের রাজনীতিতে দু’টো (সিপিএম এবং কংগ্রেস) দলের আলাদা অস্তিত্ব আছে। একটা ছোট শহরে এসে তারা হঠাৎ মিলে যাবে, এ রকম হয় নাকি! আমরা শুধু চাইছি, ভোটের সময় তৃণমূলের বাইক বাহিনীর দাপট এলাকার সবাই মিলে যাতে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়।’’

অসীমবাবুর লড়াই অবশ্য মোটেও সহজ নয়। লোকসভা ভোটের নিরিখে দেখলে বিধাননগর পুর-এলাকায় বামেদের ফল ছিল শোচনীয়। তার উপরে তৃণমূল ময়দানে নেমে পড়েছে এই প্রচার নিয়ে যে, সিপিএম আর লোক খুঁজে পেল না! ভোটে হেরে প্রত্যাখ্যাত, বর্ষীয়ান এক নেতাই বিধাননগরে সিপিএমের মুখ! অসীমবাবুও বিলক্ষণ জানেন, এই প্রচারের মোকাবিলা তাঁকে করতে হবে। করুণাময়ী এলাকায় এ দিন সন্ধ্যাতেই প্রচার শুরু করে তিনি অবশ্য মানুষের ভাল সাড়াই পেয়েছেন। সেই প্রত্যয় থেকেই প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বলছেন, ‘‘প্রচারের মোকাবিলা করব! এ বার অন্য রকম লড়াই হবে! লোকসভা ভোটে বেলা ১টার পর থেকে তো সুষ্ঠু ভোটই হয়নি।’’ বিধাননগরের মানুষ নিজের ভোট নিজে দিন এবং স্বচ্ছ প্রশাসন গড়ে উঠুক— এই দু’টি কথাই তাঁর প্রচারে তুলে আনছেন অসীমবাবু। সেই সঙ্গে বলছেন, ‘‘রাজারহাট-নিউটাউনে সিন্ডিকেটের দাপটে মানুষ অতিষ্ঠ। তাঁরা একটু শান্তি খুঁজছেন। আমরা শান্তির কথাই বলছি।’’ প্রসঙ্গত, পুরভোটে নামার ব্যাপারে অসীমবাবু গোড়ায় একটু নিমরাজি ছিলেন বলেই সিপিএম সূত্রের খবর। কিন্তু গৌতমবাবু এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মিলে বুঝিয়েছেন, বিধাননগরের মতো শিক্ষিত, শহুরে এলাকায় লড়াইয়ের উপযুক্ত মুখ তিনিই হতে পারেন। তাতে বাম কর্মী-সমর্থকেরাও বিধাননগরে হারানো জমি ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ে উৎসাহিত হবেন। আর আপত্তি করেননি অসীমবাবু।

বামেরা প্রাক্তন এক মন্ত্রীকে সামনে রেখে লড়াইয়ে নেমে যাওয়ায় বিধাননগরের পুর-যুদ্ধ আরও উচ্চতায় উঠল। গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের কাঁটায় জেরবার শাসক দলও কি চাপে পড়ল না? মানতে নারাজ তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সাফ কথা, ‘‘আমাদের সঙ্গে আছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ। আর ওরা তো প্রিমিয়ার ডিভিশনে হেরে গিয়ে এ বার সপ্তম ডিভিশনে নেমে পড়েছে! বাংলাকে দেনার দায়ে ডুবিয়ে দিয়ে গিয়ে এখন বিধাননগরকে বিক্রি করার জাল পাতছে সিপিএম! ওদের কাণ্ড দেখে মানুষ হাসছে!’’

হাসতে হাসতেই গৌতমবাবুও দাবি করছেন, ‘সিটিজেন্স ফোরাম’কে সামনে রেখে নির্বাচনের সন্ত্রাস মোকাবিলায় এ বার জোর লড়াই হবে। যদিও পার্থবাবু বা তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকেরা কটাক্ষ করছেন, বামেরা লাল পতাকা বার করতে ভয় পাচ্ছে বলে এই ফোরামের আশ্রয় নিচ্ছে! জ্যোতিপ্রিয়বাবু তো কোথাও কোথাও এমন দাবিও করেছেন, বিধাননগরে ফল ৪১-০ হবে! এই প্রশ্নে গৌতমবাবুর জবাব, ‘‘জ্যোতিপ্রিয়বাবুকে বলুন, খালের ও পারে বাইক রেখে সল্টলেকে আসতে! তার পরে দেখবেন, লোকে কেমন কান মলে দেয়!’’ কিন্তু বাইক কি কেউ রেখে আসবে? নিয়েই তো ঢুকবে! গৌতমবাবুর মন্তব্য, ‘‘আমরাও তৈরি হচ্ছি। কিছু বাইক জলে পড়বে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gautam Deb CPM left front saltlake
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE