তখনও প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হয়নি। দেওয়ালে লেখা হয়ে গিয়েছে অশোক ভট্টাচার্যের নাম।—বিশ্বরূপ বসা
পুরসভা, পঞ্চায়েতের ‘টুর্নামেন্টে’ গা ঘামানো হয়ে গিয়েছে। তাতে চমৎকার ‘কামব্যাক’-ও করা গিয়েছে। কিন্তু এ বার ‘আসল খেলা’! যেটায় না জিতলে আগের সব কিছুই এক ঝলকে ম্লান হয়ে যেতে পারে। তাই ‘ফাইনাল’ টিমের তালিকা ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগেই নিজের প্রচারে নেমে পড়লেন সেই অশোক ভট্টাচার্য। তিনিই যে বামেদের সেনাপতি।
তা ছাড়া উপায়ও ছিল না রাজ্য রাজনীতিতে যিনি ‘শিলিগুড়ি মডেল’-এর জনক হিসেবে খ্যাত অশোকবাবুর। তৃণমূল শিবির থেকে ‘রামধনু জোট’-এর ধারক-বাহক হিসেবে অবিরল কটাক্ষ ছুটে যায় তাঁর দিকে। বাম শিবিরের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের অন্যতম হিসেবে পরিচিত সেই ‘কুশলী খেলোয়াড়’কে কাবু করতে ইতিমধ্যেই তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে নামিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় ফুটবলের প্রাক্তন অধিনায়ক ভাইচুং ভুটিয়াকে। আগেই মাঠে নেমে ভাইচুং খেলাটা ধরে ফেলার চেষ্টা করছেন বুঝতে পেরেই খানিকটা বাম বিরোধী আদলেই ময়দানে নেমে পড়লেন শিলিগুড়ির মেয়র অশোকবাবুও। তাই দল প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগেই অশোকবাবুর হয়ে দেওয়াল লেখা শুরু হয়ে গিয়েছে শিলিগুড়িতে।
সোমবার সকাল থেকেই পাড়ায়-পাড়ায় অশোকবাবুর হয়ে প্রচারে নেমেছেন সতীর্থরা। রাত ৮টায় যখন প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু, তত ক্ষণে সুভাষপল্লির নেতাজি স্কুলের পাশের দেওয়াল থেকে প্রধাননগর, ডাঙ্গিপাড়া, বিস্তীর্ণ এলাকায় রং-তুলি হাতে টর্চ নিয়ে দেওয়াল দখলে ব্যস্ত দলীয় কর্মীরা। কারণ, ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটে হারের পরেও শিলিগুড়ি বিধানসভার আওতায় থাকা ৩৩টি পুর ওয়ার্ডে তৃণমূলের সংগঠন এখন অনেকটাই জোরদার। ক্লাবে-ক্লাবে দেদার অনুদান বিলি, উপরন্তু, ভাইচুং, সর্বোপরি উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের আগ্রাসী মনোভাব, সব মিলিয়ে চাপটা যে কম নয়, তা মানছেন অশোকবাবুর অনুগামীরাও। খোদ অশোকবাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘কোনও লড়াইয়ে আমরা হালকা ভাবে নিই না। শিলিগুড়ির মানুষকে গত কয়েক বছর ধরে যে ভাবে পাশে পাচ্ছি, তাতে আমি অভিভূত। শহরের সব সম্প্রদায়ের, সব স্তরের মানুষের বিচার বোধের উপরে আমার আস্থা ও শ্রদ্ধা আছে। কাজেই লড়াইয়ে জেতার ব্যাপারে আশাবাদী।’’
অশোকবাবু চারবার সিলিগুড়ি বিধানসভায় জিতেছেন। ২০১১ সালে শুধু হেরেছেন। তবে তারপরে শিলিগুড়ি পুরসভায় জিতে মেয়রও হয়েছেন। তা হলে এত দুশ্চিন্তা, চাপ কীসের!
দলের অন্দরের খবর, অতীতে মিরিক পাহাড় শিলিগুড়ি বিধানসভার আওতায় ছিল। সেখান থেকে ব্যবধান বাড়িয়ে শিলিগড়িতে নেমে জয় নিশ্চিত করে ফেলত সিপিএম। ২০১১ সালে মিরিক বাদ দেওয়া হলে ৩৩ ওয়ার্ড বিশিষ্ট হল বিধানসভা। সে যাত্রায় তৃণমূলের রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যের কাছে প্রায় ৫০০৬ ভোটে হেরে গিয়েছিলেন অশোকবাবু। তারপরে গত ২০১৫ সালে পুরভোটে ৬ নম্বর ওয়ার্ডে জিতেছেন অশোকবাবু। কিন্তু সব মিলিয়ে বামেরা ২৩টি আসন পেলেও নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। তৃণমূল ছেড়ে নির্দল হওয়া প্রার্থীর সমর্থনে বোর্ড গড়েছে তারা। শুধু তাই নয়, অশোকবাবু যেখানে জিতেছেন, সেই ৬ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ প্রার্থী যা ভোট পয়েছেন, তার চেয়ে অশোকবাবুর জয়ের ব্যবধান কম। মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত ওয়ার্ডে এখন পুর পরিষেবা নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ রয়েছে। বাণিজ্যিক ওয়ার্ডেও পুরসভার কাজকর্ম নিয়ে নানা প্রশ্ন, ক্ষোভ জমেছে। যার জবাবে প্রতিনিয়ত অশোকবাবু বলতে শোনা যায়, ‘‘রাজ্য সরকার টাকা দেয় না বলেই কাজ করতে পারছি না। তবুও নিজেরা যথাসাধ্য করে চলেছি।’’
বছরের আর পাঁচটা সময়ে অশোকবাবুর সঙ্গে দেখা হলে যতই কুশল বিনিময় হোক, ভোটের বাজারে কিন্তু হুঙ্কার দিতে ছাড়ছেন না গৌতমবাবু।
পুর পরিষেবা নিয়ে ক্ষোভকে হাতিয়ার করতে মাঠে নেমেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, ‘‘শিলিগুড়ির মানুষ জানেন কাকে ভোটে জেতালে কাজ হবে। উনি জিতলে শুধুই বিধায়ক হতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই হবেন। উনি ভাইচুংকে মন্ত্রী করবেন বলে আমার ধারণা। তা হলে যাঁকে দিয়ে কাজ হবে, মানুষ তাঁকেই বিধানসভায় পাঠাবেন।’’ এর পরেই দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দীপ্ত করতে দলের বৈঠকে মন্ত্রীকে বলতে হচ্ছে,‘‘অশোক ভট্টাচার্য বাঘ-ভালুক নন। সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। তা হলেই কাজ হবে।’’
পরিষেবা নিয়ে ক্ষোভ, আগের চেয়ে দুর্বল সংগঠনের জন্য ‘ডিফেন্স’ খানিকটা নড়বড়ে হলেও প্রতিপক্ষ শিবিরের সকলের চোখের মণি যে ভাইচুং হতে পারবেন না, সেটা দাবি করছে বাম শিবির। সেই সঙ্গে আর যেখানে যাই হোক, শিলিগুড়ির ভোটের ফল যে একটু অন্যরকম হবে বলেই আশায় রয়েছে বাম শিবির।
কিন্তু, প্রতিপক্ষ যেখানে ভাইচুং, সেখানে ‘শিলিগুড়ি মডেল’-এর ধার আগের মতোই ঝকঝক করে ওঠে না মরচে ধরে ম্রিয়মান, তাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy