Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ডেঙ্গি-তথ্য মিলছে না রাজ্যের, বলছে কেন্দ্র

দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ডেঙ্গি দ্রুত ছড়াচ্ছে। এই রোগ মোকাবিলায় রাজ্যগুলিকে প্রতিদিনের খতিয়ান দিতে বলেছিল কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের গত ৯ জুনের এক নির্দেশে, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা এবং কোথায়-কোথায় রোগ ছড়িয়ে পড়ল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পাঠাতে বলেছিল। এই তথ্য ডেঙ্গি মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করবে বলেও রাজ্যগুলির কাছে বার্তা পাঠিয়েছিল কেন্দ্র।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২১
Share: Save:

দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ডেঙ্গি দ্রুত ছড়াচ্ছে। এই রোগ মোকাবিলায় রাজ্যগুলিকে প্রতিদিনের খতিয়ান দিতে বলেছিল কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের গত ৯ জুনের এক নির্দেশে, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা, মৃতের সংখ্যা এবং কোথায়-কোথায় রোগ ছড়িয়ে পড়ল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য পাঠাতে বলেছিল। এই তথ্য ডেঙ্গি মোকাবিলার পরিকল্পনা তৈরিতে সাহায্য করবে বলেও রাজ্যগুলির কাছে বার্তা পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যে রাজ্যে ডেঙ্গিতে মৃতের সংখ্যা সব থেকে বেশি ও সংক্রমণও দ্রুত ছড়াচ্ছে বলে খবর— সেই পশ্চিমবঙ্গ থেকেই ডেঙ্গি সংক্রান্ত তথ্য আসছে না বলে অভিযোগ তুলল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক।

ডেঙ্গি পরিস্থিতির ভয়াবহতা লুকোতেই রাজ্য সরকার এই তথ্য গোপনের পথ নিয়েছে কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে। দিল্লির বক্তব্য, কেন্দ্র তথ্য না পেলে ক্ষতি রাজ্যেরই। পশ্চিমবঙ্গের কী সাহায্য দরকার তা যেমন বোঝা যাবে না, তেমনই সারা দেশের ‘প্রকৃত’ পরিস্থিতি বুঝে এই রোগের সঙ্গে লড়াইয়ের পন্থা ঠিক করতেও ভুল হবে। ১৫ অগস্টের পরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ডেঙ্গি সংক্রমণ নিয়ে দৈনিক রিপোর্ট আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়া বা ম্যালেরিয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে তথ্য গোপন করাটা গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বলেও মনে করিয়ে দিচ্ছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারা। তাঁদের বক্তব্য, খবর পাওয়া গিয়েছে, শ্রীরামপুরে ডেঙ্গি একটা সময় মহামারীর চেহারা নিয়েছিল, দমদম ও বিধাননগরে বহু মানুষ আক্রান্ত। এই অবস্থায় তথ্য গোপন করাটা আরও মারাত্মক ব্যাপার।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে যে তাঁরা দৈনিক ডেঙ্গি রিপোর্ট পাচ্ছেন না তা জানিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জগৎপ্রসাদ নড্ডার মন্তব্য, ‘‘ডেঙ্গি মোকাবিলা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনও সংঘাত নেই। সব রাজ্যের মতো ওদেরও আমরা এ ব্যাপারে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু আমার আধিকারিকরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গির যে রাজ্যওয়াড়ি রিপোর্ট আসছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ ও আরও কয়েকটি রাজ্য থেকে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তথ্যের ঘাটতি থাকছে।’’

নড্ডা আরও বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কও খুব ভাল। তাঁর রাজ্যে রোগ মোকাবিলায় ঘাটতি থাকলে তিনি তা পূরণ করে দেবেন, সেই বিশ্বাস আমাদের আছে। দরকারে আমরা সাহায্য করব। ফলে তথ্য গোপনের প্রয়োজন নেই।’’

স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে নির্দেশিকা জারি করে বলা হয়েছিল, গোটা দেশে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। এর কোনও প্রতিষেধকও বার হয়নি। এই পরিস্থিতিতে রোগটির মোকাবিলায় প্রত্যেক রাজ্যকে সংক্রমণের তথ্য নিয়মিত ও দ্রুত দিল্লিতে পাঠাতে হবে। সেই মতো পশ্চিমবঙ্গও রিপোর্ট পাঠাতে শুরু করেছিল। সংবাদ মাধ্যমকেও জানানো হচ্ছিল সেই তথ্য।

কিন্তু অগস্টে কলকাতা-বিধাননগর-দমদমে ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে বাড়তে থাকে। শ্রীরামপুরে ডেঙ্গি মহামারীর রূপ নেয়। ডেঙ্গ-২ ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে বলে জানতে পারে রাজ্য। দিল্লিতে জাতীয় পতঙ্গবাহিত রোগ মোকাবিলা কার্যক্রমের ডিরেক্টরেটে তিন সপ্তাহ আগে রাজ্য সরকার যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তাতে বলা ছিল, ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ৬,৬৫০ এবং মৃত ২৪। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় তখনই গোটা দেশে শীর্ষে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। তার পরেই রাজ্য তথ্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

এর পরেও রাজ্যে প্রতিদিন নতুন করে ডেঙ্গি আক্রান্তের খবর মিলছে। অনেকে মারাও গিয়েছেন। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, আসলে রাজ্যে ইতিমধ্যে ডেঙ্গি-আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। মৃত ৩০ জনেরও বেশি।

কিন্তু সেই তথ্য কেন পাঠানো হয়নি দিল্লিতে? রাজ্যের যুগ্ম স্বাস্থ্য অধিকর্তা (জনস্বাস্থ্য) কমলকৃষ্ণ পতির জবাব, ‘‘স্বাস্থ্য অধিকর্তাকে জিজ্ঞাসা করুন। আমরা খুব খারাপ আর অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছি। কোনও তথ্য জানানোর মতো অবস্থায় নেই। শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, আমাদের কাছে যত বছরের পরিসংখ্যান রয়েছে তার মধ্যে রাজ্যে চলতি বছর ডেঙ্গিতে আক্রান্ত ও মৃত সবচেয়ে বেশি। আমার আর কোনও বক্তব্য নেই।’’

স্বাস্থ্য ভবনের পতঙ্গবাহিত রোগ মোকাবিলা বিভাগের এক মাঝারি কর্তার কথায়, ‘‘বড়কর্তারা এক দিন আমাদের ডেকে মৌখিক ভাবে জানালেন, কোনও তথ্য প্রচার করা চলবে না। ব্যস, সকলের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। এমনকী, আমরা যাঁরা পতঙ্গবাহিত রোগ মোকাবিলা

বিভাগে মূল কাজগুলি করি, সেই স্তর পর্যন্তও এখন তথ্য পৌঁছতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরাও রোগ সংক্রমণ সম্পর্কে অন্ধকারে।’’

কেন এই ভাবে ডেঙ্গি-তথ্য চাপা দেওয়ার চেষ্টা?

স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর জবাব, ‘‘কিছু চাপা হচ্ছে না। সবই জানানো হচ্ছে। কিছু আক্রান্ত ও মৃত রয়েছেন যাঁদের প্রকৃত রোগ এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিশ্চিত ডেঙ্গি জানা গেলে তা রিপোর্টের অন্তর্ভূক্ত হবে।’’

দিল্লির কাছে রাজ্যের যে ডেঙ্গি-তথ্য রয়েছে তা তিন সপ্তাহের পুরনো। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী স্বয়ং তথ্যের ঘাটতির অভিযোগ তুলেছেন। সেই অভিযোগ কি ভুল?

স্বাস্থ্যঅধিকর্তা এ বার জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেন।

দিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রকের একাধিক কর্তা জানাচ্ছেন, অতীতে বাম আমলেও রোগ সংক্রান্ত তথ্য গোপনের নজির রয়েছে। এক বার কলেরা কলকাতা ও আশপাশের এলাকায় মহামারীর চেহারা নিয়েছিল। সেই সময়ে বিশ্বব্যাঙ্ক রোগ মোকাবিলায় অর্থ সাহায্য দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পরেই রাজ্য কলেরা আক্রান্তদের যাবতীয় তথ্য গোপন করতে শুরু করে। আখেরে সে বার ক্ষতি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গেরই। অতীতে পানীয় জলে আর্সেনিক এবং ফ্লোরাইডের সংক্রমণ নিয়েও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তথ্য গোপন করায় এই দুই ধরনের দূষণ মোকাবিলায় নামতে অনেক দেরি হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

dengue information
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE