Advertisement
E-Paper

ক্লাবের হাতে কলেজ ছাই, ত্রস্ত এলাকা

জমি নিয়ে বিবাদ। তার জেরেই ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল পাশের জমিতে গড়ে ওঠা একটি বিএড কলেজে। আগুন লাগানো হল কলেজের মালিকের বাড়িতেও। বুধবার সকালে বালি বসুকাঠি আনন্দনগরের ওই বেসরকারি বিএড কলেজে এই ঘটনার পরে দমকলের চারটি ইঞ্জিন এসে আগুন নেভায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৬ ০৪:০৫
আগুনের গ্রাসে আক্রান্ত কলেজ (বাঁদিকে)। পালিয়ে যাচ্ছেন আতঙ্কিত ছাত্রীরা (ডানদিকে)।

আগুনের গ্রাসে আক্রান্ত কলেজ (বাঁদিকে)। পালিয়ে যাচ্ছেন আতঙ্কিত ছাত্রীরা (ডানদিকে)।

জমি নিয়ে বিবাদ। তার জেরেই ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল পাশের জমিতে গড়ে ওঠা একটি বিএড কলেজে। আগুন লাগানো হল কলেজের মালিকের বাড়িতেও।

বুধবার সকালে বালি বসুকাঠি আনন্দনগরের ওই বেসরকারি বিএড কলেজে এই ঘটনার পরে দমকলের চারটি ইঞ্জিন এসে আগুন নেভায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রথমে পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়। পরে পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে নামানো হয় কমব্যাট ফোর্স ও র‌্যাফ। হাওড়া সিটি পুলিশের কমিশনার দেবেন্দ্রপ্রকাশ সিংহ বলেন, ‘‘একটি জমিকে কেন্দ্র করে কলেজের মালিকের সঙ্গে ক্লাবের গণ্ডগোল চলছিল। তার জেরেই ক্লাবের লোক এবং স্থানীয় বাসিন্দারা মিলে ভাঙচুর করেছেন বলে অভিযোগ পেয়েছি। ইতিমধ্যেই ১৩-১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ খবর জেনে স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে এবং এলাকায় বিধায়ক তথা মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্দেশ দেন, রাজনীতির রং বিচার না করে অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০৫ সালে আনন্দনগরের বাসিন্দা পেশায় আইনজীবী বিষ্ণুপদ দাস তাঁর বাড়ির পিছনে নিজেদের কয়েক বিঘা জমিতে ঠাকুরদা সুরেন্দ্রলাল দাসের নামে একটি বিএড কলেজ তৈরি করেন। পাঁচতলা কলেজ ভবনের সামনে বিষ্ণুবাবুর দোতলা বাড়ির পাশে প্রায় ১০ কাঠা জমির একাংশে রয়েছে দোতলা একটি ক্লাব। পুলিশ জানায়, ওই ক্লাবকে কেন্দ্র করেই বিষ্ণুবাবুর সঙ্গে স্থানীয় যুবকদের মতানৈক্য ও জমি বিবাদের সূত্রপাত।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কলেজের সামনের জমি থেকে ক্লাবটিকে সরে যেতে চাপ দিচ্ছিলেন বিষ্ণুবাবু। ওই জমি নিয়ে মামলাও শুরু হয়েছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিষ্ণুবাবু সোমবার রাতে কয়েক জন দুষ্কৃতীকে ক্লাবে পাঠিয়ে জায়গা ছেড়ে যেতে হুমকি দেন। পাশাপাশি, ওই রাতেই ক্লাবের কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে নিশ্চিন্দা থানায় তাঁকে হেনস্থা করার অভিযোগও দায়ের করেন তিনি। এ দিন বিষ্ণুবাবু বলেন, ‘‘ওই ১০ কাঠা জমির এক পাশে ক্লাবের কিছুটা জমি রয়েছে। সেখানে ঘর না বানিয়ে ওঁরা অন্যত্র বাড়ি তুলে পুরো জায়গাটা দখল করতে চাইছিল।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘ক্লাবের অসামাজিক কাজে প্রতিবাদ করতাম। মোটা টাকা চাঁদা চাইলেও দিতাম না। তাই ওরা এই ভাঙচুর করেছে।’’

কী ঘটেছিল এ দিন?

পুলিশ জানায়, সকাল ৯টা নাগাদ স্থানীয় মহিলারা ও ক্লাবের কয়েক জন সদস্য প্রথমে বিষ্ণুবাবুর বাড়ির সামনের রাস্তা অবরোধ করেন। দাবি তোলেন ক্লাবের সদস্যদের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা অভিযোগ তুলে নিতে হবে। সেই সময়ে বাড়িতে ছিলেন বিষ্ণুবাবু ও তাঁর মা কুন্তলাদেবী। তাঁর স্ত্রী, বিএড কলেজটির অধ্যক্ষা অনুরাধা দাস পাঁচ বছরের মেয়েকে ডানকুনিতে স্কুলে দিতে গিয়েছিলেন। অভিযোগ, অবরোধ চলাকালীন বেশ কিছু বহিরাগতও জড়ো হয়। বিষ্ণুবাবুর বাড়ি ও কলেজে ঢোকার গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। বাড়ির একতলায় ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আগুন লাগানো হয় বা়ড়ির নীচে রাখা গাড়িতেও। পুড়িয়ে দেওয়া হয় আরও দু’টি মোটরবাইকও। কুন্তলাদেবী বলেন, ‘‘তাণ্ডব চলছে দেখে ভয়ে আমরা একটা ঘরে ঢুকে বাইরে থেকে কোল্যাপসিব্‌ল গেটে তালা লাগিয়ে দিই। যখন আগুন ধরিয়ে দিল, তখন বুঝতে পারছিলাম না, কী করব। মনে হচ্ছিল, নীচে ঝাঁপ দিয়ে দিই।’’

অভিযোগ, এর পরে তাণ্ডবকারীরা চলে যান বিএড কলেজ ভবনে। বাঁশ, কাঠ, রড দিয়ে পাঁচতলা বাড়িটির সমস্ত ঘরের আসবাবপত্র, চেয়ার টেবিল, আলমারি, কম্পিউটার-সহ সমস্ত কিছু ভাঙা হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় কম্পিউটার রুম, ডিরেক্টরের ঘর-সহ বেশ কয়েকটি ঘরে। সেই সময়ে কলেজের লাগোয়া ভবনে হস্টেলে ছিলেন ৩০ জন মতো আবাসিক পড়ুয়া। ভয়ে চিৎকার জুড়ে দেন তাঁরা। কলেজের ক্যান্টিনের কর্মী শুকদেব খাঁ বলেন, ‘‘মেয়েরা ভয়ে চিৎকার করছিল। বেরোনোর পথ না পেয়ে আমিও কোনও মতে একটা ঘরে লুকিয়ে পড়ি।’’ এর পরে ওই বাড়িটিতেও হামলাকারীরা ভাঙচুর শুরু করে বলে অভিযোগ। খবর পেয়ে আসে নিশ্চিন্দা থানার একটি টহলদারি গাড়ি। মাত্র চার জন পুলিশকর্মী পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হন।

হামলাকারীদের ধাওয়া পুলিশের। বুধবার, বালিতে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে খবর পেয়ে ১২টা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বিশাল পুলি‌শবাহিনী। প্রায় শ’খানেক হামলাকারীকে হটাতে বেধড়ক লাঠি চার্জ শুরু করে পুলিশ। এমনকী, বন্দুক উঁচিয়েও তাড়া করেন পুলিশকর্মীরা। এর মধ্যেই খবর আসে বিএড কলেজ থেকে হাঁটাপথে তিন মিনিটের দূরত্বে থাকা বিষ্ণুবাবুর আর একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুন্তলা বেসিক ট্রেনিং কলেজেও হামলা শুরু হয়েছে। সেখানেও ব্যাপক ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানেও ছোটে পুলিশ। লাঠি চার্জ করে গোটা এলাকা ফাঁকা করে দেওয়া হয়। পুলিশ প্রথমে ৩৫ জনকে আটক করলেও সেই দলে কয়েক জন নিরীহ পথচারী থাকায় পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে যান এসিপি (উত্তর) নাসিম আখতার। কলেজের কর্মীদের অভিযোগ, এ দিন পুলিশ দেরিতে আসায় হামলাকারীরা তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। যদিও দেরিতে আসার কথা স্বীকার করেননি পুলিশকর্তারা।

এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, কলেজ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন পড়ুয়ারা। তাঁরা বলেন, ‘‘এমন আতঙ্ক নিয়ে থাকা যায় না। ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষা। জানি না কী হবে।’’ কলেজে গিয়ে দেখা যায়, সমস্ত ঘর লণ্ডভন্ড। গোটা বারান্দা জুড়ে ভাঙা কাচ, চেয়ার-টেবিলের স্তূপ। দুপুরেও ঘর থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখা গিয়েছে।

অন্য দিকে, ১৯৮৫ সালে তৈরি রেজিস্টার্ড ওই ক্লাবে মূল গেটে ব্যানার ঝুলছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্থানীয় বিধায়ক তথা মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া ওই ব্যানারে লেখা, রাজ্য সরকারের থেকে ২ লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছে তারা। যদিও এ দিনের ঘটনার পরে বিষ্ণুবাবু বলেন, ‘‘কলেজে তাণ্ডবের সঙ্গে রাজনীতির কোনও রকম যোগ নেই। শাসক দলের কেউই এতে জড়িত নন। বরং রাজীববাবু অনেক সময়েই সমস্যার মীমাংসার চেষ্টা করেছেন। আজ ক্লাবের সদস্য ও বহিরাগতেরা মিলে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে।’’

কী কারণে এই হামলা? পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, এক সময়ে বালির ওই এলাকা জুড়ে ছিল নিচু জমি। বছর পনেরো আগে ওই বিএড কলেজের সামনের ১০ কাঠা জমির উপরেই ছিটে বেড়া দিয়ে ক্লাব তৈরি করেছিলেন স্থানীয় যুবকেরা। এলাকার পুরনো বাসিন্দারা জানান, ওই জমির মালিক ছিলেন বাংলাদেশের এক বাসিন্দা। সে সময়ে ক্লাবের সম্পাদক পদে ছিলেন বিষ্ণুবাবু নিজেই। যদিও এ দিন সে কথা অস্বীকার করে তিনি বলেছেন, ‘‘প্রথম থেকেই আমি জমি দখল করে ক্লাব তৈরির বিপক্ষে ছিলাম।’’ স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বছর দশেক আগে আচমকাই ক্লাব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন বিষ্ণুবাবু। এর পরেই জানা যায়, ক্লাব-সহ ১০ কাঠা জমি কিনে নিয়েছেন বিষ্ণুবাবুরই আত্মীয়। তা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে বিবাদ শুরু হয় ক্লাব সদস্যদের। ক্লাবের দাবি ছিল— জমিটি বাংলাদেশের যে ব্যক্তির নামে, দীর্ঘদিন তাঁর কোনও হদিস নেই। তাই ওই জমি কেনার যে নথি দেখানো হচ্ছে, তা ভুয়ো। একচুল জমিও ছাড়া হবে না বলে জানিয়ে দেয় ক্লাব। কিন্তু বিষ্ণুবাবু তা মানতে নারাজ ছিলেন। এ নিয়ে দুই পক্ষ রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেও যান। রাজীববাবু বলেন, ‘‘ওঁদের বলেছিলাম নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মীমাংসা করে নিতে। না হলে আদালতে গিয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে।’’ তবে এ দিন কলেজে ভাঙচুর ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।

ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।

bally anandanagar college chaos
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy