মাত্রাছাড়া টাকা নিলে বা চিকিৎসায় গাফিলতি করলে যাতে দোষী হাসপাতালের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় তার পন্থা নির্ধারণ করতে শেষ পর্যন্ত বৈঠকে বসছেন মুখ্যমন্ত্রী। আজ, বুধবার টাউন হলে হবে সেই বৈঠকে। থাকবেন তাবড় স্বাস্থ্যকর্তা এবং বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধিরা।
এই রকম একটা পদক্ষেপ করা যে দরকার সেই বিষয়ে বিভিন্ন মহলে চর্চা শুরু হয়েছিল অনেক দিনই। সম্প্রতি সিএমআরআই-কাণ্ড এবং আরও কয়েকটি ঘটনা সরকারকে বেসরকারি হাসপাতালগুলির উপর নজরদারি, এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে সক্রিয় হওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। যদিও বেসরকারি হাসপাতালগুলির কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, দু’-একটি হাসপাতালের কুকর্মের জন্য তাদের সকলের দিকে আঙুল উঠছে। হাসপাতাল ব্যবসা চালাতে গিয়ে হাজারো ঝক্কি সামলেও তাঁরা কী ভাবে সবচেয়ে ভাল পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেটাই বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ব্যাখ্যা করতে চান তাঁরা।
মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর্তারা যে ফাইল তৈরি করেছেন, তাতে অবশ্য তাঁরা জানিয়েছেন, বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তাদের শাস্তি দেওয়ার মতো কোনও জোরালো আইন দফতরের হাতে নেই। সমস্যা সেখানেই। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রতি বছর গড়ে আড়াইশো থেকে সাড়ে চারশো অভিযোগ জমা পড়ে স্বাস্থ্য দফতরে। এর মধ্যে কোনওটি অস্বাভাবিক চড়া বিল নিয়ে, কোনওটি চিকিৎসায় গাফিলতির, আবার কোনওটা হয়তো চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহার সংক্রান্ত। অনেক ক্ষেত্রে এই সব অভিযোগ খতিয়ে দেখে রিপোর্টও তৈরি করা হয়। কিন্তু এর পরে আর এগোতে পারে না স্বাস্থ্য দফতর!
স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্লের অফিস সূত্রের খবর, ২০১৫ সালে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য দফতরে ৩১৪টি অভিযোগ জমা পড়েছিল। তার মধ্যে ১৬৭টি ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল স্বাস্থ্য দফতরের তদন্তে। কিন্তু শুধু রিপোর্ট পাঠিয়েই দফতরকে ক্ষান্ত হতে হয়েছে। শাস্তি দেওয়া যায়নি। পরের বছর, ২০১৬-তে স্বাস্থ্য দফতরে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ২৮৩টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ৭৬টি, অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ ৪টি, নিয়ম ভেঙে ভ্রূণের লিঙ্গ পরীক্ষার অভিযোগ ১২টি। এর মধ্যে ৭টি অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে। ৫টির ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং অভিযোগকারীকে সেই রিপোর্ট পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে। এর বেশি আর স্বাস্থ্য দফতর এগোতে পারেনি।
কী ধরনের অভিযোগ স্বাস্থ্য দফতরের কাছে এসেছে? যে ফাইল মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়া হবে তাতে থাকছে মালদহের কৃষ্ণপল্লীর বছর বাহাত্তরের মোহন চন্দ্র রায়ের ঘটনা। গত ২৮ ডিসেম্বর কলকাতার মুকুন্দপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। বাড়ির লোকের অভিযোগ ছিল, অস্ত্রোপচার, ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সমেত ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকার প্যাকেজ দিয়েছিল হাসপাতাল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিল ধরানো হয়েছিল ১১ লক্ষ ২২ হাজার টাকার।
আর একটি ঘটনা, কলকাতার নীলমণি হালদার লেনের বাসিন্দা রাফত আরা প্রবল কাশি নিয়ে ক্রিক রো এলাকার এক হাসপাতালে ভর্তি হন ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। রোগীর বাড়ির লোকের অভিযোগ, হাসপাতালে মাত্র কয়েক দিন থাকতে হবে ও ৪০ হাজার টাকা লাগবে বলেন চিকিৎসক। কিন্তু বাড়ি ফেরা হয়নি রোগীর। ৯ মার্চ রাফত মারা যান। হাসপাতাল বিল ধরায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকার।
স্বাস্থ্যকর্তাদের স্বীকারোক্তি, এখন বিলের ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীকে সেই রিপোর্ট পাঠানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য দফতর থেকে তাঁকে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আর হাসপাতালের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেই রিপোর্ট অভিযোগকারীর কাছে পাঠানোর পাশাপাশি মেডিক্যাল কাউন্সিলে অভিযোগ জানানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এর বেশি কিছু করার ক্ষমতা নেই স্বাস্থ্য দফতরের!
একে অবশ্য ‘মিথ্যে অজুহাত’ বলেছেন রোগীদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা ‘পিপল ফর বেটার ট্রিটমেন্ট’-এর মতো সংস্থা বা স্বাস্থ্য আন্দোলনে জড়িত পুণ্যব্রত গুণদের মতো ব্যক্তিরা। তাঁদের মতে, স্বাস্থ্যকর্তারা সত্যিই বেসরকারি হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলে ২০১০ সালের ‘নতুন ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট আইন’ পাশ হয়ে যাওয়ার পরেও তার বিধি না বানিয়ে পাঁচ বছর ফেলে রাখা হতো না। পুণ্যব্রতবাবুর কথায়, ‘‘পুরনো ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট আইন অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের অধিকার রয়েছে স্বাস্থ্য দফতরের। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বেশি টাকা নেওয়া বা চিকিৎসায় গাফিলতির জন্য কোনও হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল বা সাসপেন্ড করেননি স্বাস্থ্যকর্তারা। কারণ তাঁদের অনেককেই বেসরকারি হাসপাতাল মুঠোয় পুরে রেখেছে।’’
হাতে গোনা কিছু হাসপাতাল অতিরিক্ত লাভের জন্য যে রোগীকে আর্থিক ভাবে শোষণ করে তা মেনে নিয়েও বেসরকারি হাসপাতালগুলির একটি বড় অংশ দাবি করেছে, কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও তাঁরা ন্যূনতম লাভ রেখে সবচেয়ে ভাল পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করে। মুকুন্দপুরের এক হাসপাতালের কর্তাদের কথায়, ‘‘বহু লোক রোগীকে ভর্তি করে টাকা দেন না, যাতে টাকা দিতে না হয়, তার জন্য গোলমাল করেন, ভাঙচুর চালান, রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে ভয় দেখান। তার পরেও আমরা পরিষেবা বন্ধ করি না।’’ তাঁদের আরও বক্তব্য, সরকারি হাসপাতালের নিরিখে অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে যে পরিচ্ছন্নতা-খাবার-ঘর-শৌচাগার-যন্ত্রপাতি রাখা হয় তাতে বেশি টাকা তো লাগবেই।
ঢাকুরিয়ার আর এক হাসপাতালের কর্তার কথায়, ‘‘আমরা সরকারের কাছ থেকে ১ টাকায় জমি পেয়েছিলাম। তার জন্য প্রতি মাসে নিখরচায় ৩০-৪০ জন দরিদ্র রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এর বাইরেও অনুরোধ-উপরোধে বিল কমাতে হয় অনেক রোগীর। কিন্তু যেহেতু আমরা ব্যবসা করছি, দাতব্য চিকিৎসালয় খুলিনি, তার জন্য কিছুটা লাভ তো করতেই হবে। সব তথ্যই মুখ্যমন্ত্রীকে জানাবো।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy