Advertisement
০২ মে ২০২৪

বাধ্যতামূলক হাজিরা ঘিরে গোলযোগের পিছনেও ‘ভর্তি-দাদা’রা!

এবার ক্লাসে ৬০ শতাংশ বাধ্যতামূলক হাজিরা ঘিরে গোলযোগের পিছনেও ‘দাদা’দের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে।

 —ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:৫০
Share: Save:

ভর্তিতেও আছেন, হাজিরাতেও আছেন।

মাস কয়েক আগে কলেজে টাকা নিয়ে ভর্তি করানোর ঘটনায় যেমন ইউনিয়ন-দাদাদের নাম জড়িয়েছিল, এবার ক্লাসে ৬০ শতাংশ বাধ্যতামূলক হাজিরা ঘিরে গোলযোগের পিছনেও ‘দাদা’দের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। চয়েজ বেসড ক্রেডিট সিস্টেম (সিবিসিএস) চালু হওয়ার পরে বিভিন্ন কলেজে বিক্ষোভ, ঘেরাও, হাজিরা-খাতা ‘লুটে’র ঘটনা কেন ঘটছে, তা খোঁজ করতে গিয়ে জানা যাচ্ছে ‘হাজিরা-দাদা’দের কথা। যাঁরা পড়ুয়াদের ক্লাস না করেও পার পাওয়ানোর বরাভয় দিয়ে এসেছেন যুগে যুগে, কিন্তু নতুন নিয়মের ঠেলায় এখন কিছু করতে পারছেন না। ফলে সম্মুখ সমর! অবস্থা এমনই যে মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যকে একটি বৈঠকে জানিয়ে দেন, কলেজের পড়ুয়া নন, এমন কেউ যেন কলেজের বিষয়ে নাক না গলান।

সূত্রের খবর, বিভিন্ন কলেজের বিষয়ে বহিরাগত দলীয় নেতারা যেভাবে ‘হস্তক্ষেপ’ করছেন, তা শিক্ষামন্ত্রীর পছন্দ নয়। এ দিন বেহালা কলেজের হাজিরা-গোলমাল মেটাতে গিয়ে ডাকা বৈঠকে এ কথা স্পষ্ট করেছেন পার্থবাবু। ওই কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে টাকার বদলে পড়ুয়াদের ক্লাসে হাজিরা বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সামনে এসেছে টিএমসিপি’র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও। এ ক্ষেত্রে টিএমসিপি-র মধ্য কলকাতার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকে আরও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন পার্থবাবু।

আরও পড়ুন: গোত্র জানালেন রাহুল, বিপাকে বিজেপি-ই

পার্থবাবু এই নির্দেশ দিলেও শহরের বিভিন্ন কলেজ যাঁদের ছত্রছায়ায় চলছে বলে অভিযোগ, তাঁদের দাবি, হাজিরা-কাণ্ডে তাঁদের যোগ-ই নেই। মধ্য কলকাতার তৃণমূল নেতা তথা সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজের ‘দাদা’ বলে পরিচিত প্রিয়াল চৌধুরী (ছাত্র নন) বলেন, ‘‘ছাত্ররা মনে করে, ইউনিয়নের সঙ্গে থাকলে সমস্যার বৈতরণী এমনিই পেরিয়ে যাবে। কে কী মনে করবে, তার দায় কি নেতা-দাদাদের?’’ উত্তর কলকাতার টিএমসিপি-র সভাপতি বিশ্বজিৎ দে (ছাত্র নন) বলেন, ‘‘এই দাদাটা-কে? সেটা আগে খুঁজে বার করতে হবে।’’ দক্ষিণ কলকাতার টিএমসিপি-র সভাপতি সঞ্জয় দে-র (ইনিও ছাত্র নন) কথায়, ‘‘ছাত্ররা ক্লাসে না এলে রাজনীতি কি চেয়ার-টেবিল নিয়ে হবে? আমাদের স্বার্থেই তো ছাত্রদের ক্লাসে দরকার।’’ বৈঠকের পর তৃণাঙ্কুরেরও দাবি, ‘‘তৃণমূল ছাত্র পরিষদ কোনও ভাবেই এই বিষয়গুলির মধ্যে থাকবে না। কারণ, ছাত্র হলে পড়াশোনা করতেই হবে।’’

আরও পড়ুন: শিবরাজের তরী বাঁচবে তো? চিন্তায় অমিত


যদিও বিভিন্ন কলেজের অভিযোগ, দাদাদের ‘দাপটে’র সামনে অনেক কিছুই বদলে যায়, এমনকি, বদল হয় হাজিরা খাতাতেও। যেমন অনেক কলেজেই পড়ুয়ারা হাজির না থাকলে ‘অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টারে’ একটি ‘ডট’ দেন শিক্ষকেরা। অভিযোগ, তারপর সেই ডট বদলে যায় এক বা দুইয়ে। অর্থাৎ ছাত্র ক্লাসে ছিলেন। এই ঐতিহ্য এমনই যে অনেক কলেজ কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভুল হাজিরার নথি পাঠিয়ে দেন বলেও অভিযোগ। শিক্ষকদের একাংশের বক্তব্য, ‘‘ওই সব কলেজ ভাবছে, হাজিরা খাতা বিশ্ববিদ্যালয় কখনওই দেখতে চাইবে না। যদি চায়, তখন দেখা যাবে। ততদিন যা চলছে, চলুক!’’ কিন্তু যে সমস্ত কলেজ এই পথ ধরছে না, সেখানেই পড়ুয়াদের বিক্ষোভের পথে যেতে হচ্ছে বলে মত শিক্ষামহলের। অভিযোগ, কলকাতার শহরতলির একটি কলেজে হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ির পর ‘দাদা’ এমনকি, ‘দাদার দাদা’র তরফে ফোন করে বলা হয়েছে, ‘অন্যরা তো ছেড়ে দিয়েছে। আপনারা এত কড়াকড়ি করছেন কেন?’
গত সোমবারই সেন্ট পলস কলেজে পড়ুয়াদের হাতে ঘেরাও হয়েছেন টিচার ইনচার্জ দেবাশিস মণ্ডল। রাতে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। চাপের মুখে টিচার ইনচার্জ জানান, উপস্থিতির হার-সহ পড়ুয়াদের নামের যে তালিকা টাঙানো হয়েছে, তা নাকি তাঁর অজান্তেই হয়েছে। ওই কলেজের পড়ুয়াদের অভিযোগ, ‘দাদা’রা বলেছিলেন, উপস্থিতির হার নিয়ে কলেজ সমস্যা করলে, তাঁরা বুঝে নেবেন। এক ছাত্রের কথায়, ‘‘কই, দাদারা তো কিছুই করল না!’’ উত্তর কলকাতার জয়পুরিয়া কলেজে হাজিরা খাতাই ছাত্রদের একাংশ ‘লুট’ করে পালিয়েছেন বলে অভিযোগ। এ বিষয়েও শিক্ষামন্ত্রীকে এদিন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘হাজিরা নিয়ে যে গোলমালই হোক, সংশ্লিষ্ট কলেজ কর্তৃপক্ষকে সেটা বুঝে নিতে হবে। দেখা যাচ্ছে, এই সব কলেজের কর্তৃপক্ষ এক পক্ষকে মদত দেন। পরে আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।’’ কলেজ কর্তৃপক্ষই যদি গোলমাল হলে বুঝে নেবে, তাহলে তিনি বেহালা কলেজ নিয়ে বৈঠক করলেন কেন? মন্ত্রীর যুক্তি, কলেজটি তাঁর বিধানসভা কেন্দ্রের আওতায় পড়ে। তাই তিনি ওই কলেজ নিয়ে বৈঠক করেছেন।
পুরনো নিয়মে স্নাতকে ৬০-৭৫ শতাংশ হাজিরা থাকলে জরিমানা দিয়ে পরীক্ষায় বসা যেত। ৬০ শতাংশের কম হলে পরীক্ষায় বসা যেত না। কিন্তু অধিকাংশ কলেজ সেই নিয়ম মানত না বলেই অভিযোগ। উত্তর কলকাতার একটি কলেজের অধ্যক্ষ জানালেন, ১০ শতাংশেরও কম হাজিরা রয়েছে, এ রকম পড়ুয়াদেরও তখন পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হত। তার প্রধান কারণ ছিল, ক্ষোভ-বিক্ষোভ এড়ানো। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আর উদাসীন থাকা যাচ্ছে না। কারণ, নতুন নিয়মে ওই হাজিরার ওপর ১০ নম্বর ধার্য রয়েছে। সম্প্রতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক দফতর থেকে জরিমানা ধার্য করে এ বারের মতো পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু যেহেতু হাজিরার উপর নম্বর ধার্য রয়েছে, সেজন্য অধিকাংশ কলেজ কর্তৃপক্ষ ধন্দে পড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ামক জয়ন্ত সিংহকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

(তথ্য সহায়তা: মধুমিতা দত্ত, সুপ্রিয় তরফদার, নীলোৎপল বিশ্বাস)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE