Advertisement
E-Paper

জানা নেই ক্লাইম্যাক্স, এ যেন কুড়ি পয়সার পালা!

পাঁচশো-হাজার টাকার নোট বাতিলের কথা শোনার পরেই প্রথম মনে পড়েছিল, আমাদের দেশ কি আবার উনিশশো সাতাশির আগের পৃথিবীতে ফিরে গেল? ‘গোল্ডস্পট’ কি ফিরে আসবে আবার?

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৬

পাঁচশো-হাজার টাকার নোট বাতিলের কথা শোনার পরেই প্রথম মনে পড়েছিল, আমাদের দেশ কি আবার উনিশশো সাতাশির আগের পৃথিবীতে ফিরে গেল? ‘গোল্ডস্পট’ কি ফিরে আসবে আবার? টেলিভিশনে ফিরে আসবে ‘জনি সোকো অ্যান্ড হিজ ফ্লাইং রোবোট’? রোগা সলমন খান! আনন্দমেলার পাতায় কি তবে আবার দেখতে পাব রোভার্সের রয়কে!

কিন্তু তার পরেই চিন্তায় দাঁড়ি দিয়ে ফোন আসতে শুরু করল পরপর। লেখার পাশাপাশি ব্যবসার কাজেও যুক্ত থাকায় বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় আমার। ফলে নানা শ্রেণির মানুষের নানা মত ও আশঙ্কা শুনতে শুরু করলাম। আর তা দিয়েই বুঝলাম, দীর্ঘদিন ধরে সাজানো একটা দাবার বোর্ডকে আচমকাই যেন ঘেঁটে দিয়েছে কোনও এক দামাল ছেলে! ফাঁকা বোর্ডে এখন ছিটকে পড়ে রাজা, মন্ত্রী, গজ, বোড়ের দল...। আমি বা আমরা তো বোড়ে। তাই সত্যি বলতে কী আদার ব্যাপারী হয়ে এই টানাটানির সময়টা খুব বুঝতে পারলেও, গল্পের ক্লাইম্যাক্সটা এখনও স্পষ্ট নয়।

যখন ফুটবল বা ক্রিকেটের বিশ্বকাপ চলে, বহু মানুষ তখন কোচ বা ম্যানেজারের ভূমিকায় আসরে নেমে পড়েন। যখনই পেল্লায় ব্যানারের সিনেমা রিলিজ করে, তখন সকলেই ক্রিটিক। আর তাই এখন এই ‘ডিমনিটাইজেশন’-এর সময় প্রায় সকলেই অর্থনীতিবিদ। চপের দোকান থেকে জুয়েলারি শপের মালিক সব স্তরের মানুষের মুখে ‘‘আমি মোদী হলে...’’ দিয়ে শুরু হওয়া বাক্য এই ক’দিনে যে কত বার শুনলাম! কেউ খুশি, কেউ দুঃখিত। কেউ আবার মুখে হাসি, বুকে বল দেখালেও ভেতরে ভেতরে কেঁপে গিয়েছেন।

আমার কন্যা সায়েকার বয়স সাত বছর। তার সব চেয়ে পছন্দের কাজ ছবি আঁকা। খাতাপত্র উপচে যা প্রায়ই স্থান করে নেয় ঘরের দেওয়ালে। সে আমায় এর মধ্যেই এক দিন খাতা এনে দেখাল, ‘‘এই দেখো বাবা কী এঁকেছি!’’ অয়েল প্যাস্টেলে আঁকা কালো আয়তাকার কিছু ছবি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কী এগুলো?’’ ইংরেজি মাধ্যমে পড়া মেয়ে আমার হেসে বলল, ‘‘ব্ল্যাক মানি। টিভিতে বলছিল।’ সেই ‘শাখা প্রশাখা’ ছবির এক নম্বরি আর দু’নম্বরি যেন নতুন করে ফিরে এল! পরের প্রশ্নটি ছিল আরও মোক্ষম, ‘‘বাবা, ব্ল্যাক মানি কী গো? ব্ল্যাক কালারের নোট? এতে কি প্রবলেম হচ্ছে?’’

আমি তাকে বোঝাতে যাইনি কালো টাকার মানে। সব খারাপ এত তাড়াতাড়ি না বুঝলেও চলবে তার! জীবন নিজের নিয়মেই সময়মতো সব অন্ধকার গলিঘুঁজি শিখিয়ে দেয়, চিনিয়ে দেয়। তবে ‘প্রবলেম’ যে হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। ‘অসাধারণ’দের কথা জানি না, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে রোজকার খরচের টাকা হঠাৎ অচল হয়ে গেলে কেমন লাগে, তা তো আমি জানি।

আমার মফস্সলি ছোটবেলার কথা মনে আছে। মায়ের ছিল পান খাওয়ার অভ্যেস। ছুটির দুপুরগুলোয়, হাতে কুড়ি পয়সা দিয়ে মা আমায় পাঠাতেন পানের দোকানে। পানওয়ালা দাদু জানতেন, আমি আসব মায়ের জন্য পান নিতে। ষাট-জর্দা দেওয়া, খয়ের ছাড়া, মিঠে পাতার সেই পান আগে থেকেই সেজে কাগজে মুড়ে রাখতেন। আমি গিয়ে ছ’কোণা কুড়ি পয়সার কয়েন দিতাম দাদুকে। আর দাদু আমার হাতে ধরিয়ে দিতেন পানটি। এমনই এক দিন পানওয়ালা দাদু পয়সাটা হাতে নিয়ে কিছু ক্ষণ দেখলেন। তার পর ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এটা চলবে না।’ চলবে না! কেন? কারণ কয়েনের গায়ে ২০ লেখাটা নাকি ঘষে উঠে গিয়েছে প্রায়! সেই ন’বছর বয়সের আমি ছ’কোণা কুড়ি পয়সা হাতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছিলাম দুপুর-রোদ্দুরে। চলবে না পয়সা! তা হলে আমি পানটা নেব কেমন করে? মা কী বলবেন? দাদু হেসে বলেছিলেন, ‘‘পান নিয়ে যাও। কাল পয়সা দিয়ে দিও।’’ আটই নভেম্বরের পরে আচমকা অনেকেরই অবস্থা হয়েছে সেই ছোটবেলার আমার মতো। একটু আগেও যে নোটটা দোলালে তামাম দরকারি ও অদরকারি জিনিস করতলগত হচ্ছিল সেই নোট কি না বাতিল! অচল!

এর আগেও শুনেছি আমাদের দেশ এমন অবস্থায় পড়েছিল। উনিশশো আটাত্তরের জানুয়ারিতে। কিন্তু তখন তো আমার বয়স দেড় বছর। এক পয়সা আর এক কোটি টাকায় ফারাক নেই। তাই জানি না তখন কী হয়েছিল। কিন্তু এ বার যেন এক অদ্ভুত ‘পালা’ বসে গিয়েছে। যাঁরা বিরোধীর ভূমিকায়, তাঁদের গলায় যেমন জোর নেই, তেমনই যাঁরা সমর্থকের পার্ট করছেন তাঁরাও ক্ষণিকের উত্তেজনা কমার পরে বুঝতে পারছেন না ভবিষ্যতে ঠিক কী হতে চলেছে।

লাইনেই তো...! সোমবার হাওড়ায় স্টেট ব্যাঙ্ক ই-কর্নারের সামনে।—নিজস্ব চিত্র

যেমন নোট বাতিলের পরেও দক্ষিণ কলকাতার আজাদগড় বাজারে দেখলাম, পাঁচশো-হাজারের নোট নেওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞেস করতে মাছের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে বিক্রেতা বললেন, ‘‘না নিলে তো বিক্রি হবে না। সংসার চলবে কী করে?’’

রাসবিহারী মোড়ে গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ালেই কিছু ভিক্ষাজীবি কিন্নর এসে দাঁড়ান সামনে। তেমনই এক জন বললেন, ‘‘দাদা কিছু অন্তত দিন। আগে লোকজন দশ টাকাও দিত। এখন কেউ কিছু দিচ্ছে না।’’

আমার পরিচিত এক জন ফিল্ম ডিরেক্টর আবার উচ্ছ্বসিত। ফোন করে বললেন, ‘‘দারুণ হয়েছে কিন্তু! সব ব্যাটাকে এক ধাক্কায় এক প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে! আজ আমাদের দিন! পয়সাওয়ালাদের মস্তানি বহু সহ্য করেছি, আর নয়!’’

যত দিন যাচ্ছে খবর পাচ্ছি, ওই জায়গায় এত কোটি টাকা মিলেছে। অত কোটির ছেঁড়া নোটের বস্তা অমুক জায়গায় উদ্ধার হয়েছে। মেসেজে খবর আসছে কোন খাবারের দোকানে কত অলিখিত টাকা ছিল। কোন মানুষ আত্মহত্যা করেছে! কোন দোকানে ইনকাম ট্যাক্সের রেড হয়েছে।

এ সব খবর পেয়ে আমজনতার ‘বেশ হয়েছে!’ বা ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’ মনোভাবের মধ্যেও ব্যাঙ্কে ক্রমে দীর্ঘ হয়েছে উদ্বিগ্ন মানুষের লাইন! এটিএমের সামনে পিঁপড়ের মতো ভিড় করেছে আতঙ্কিত মুখগুলো! আর এত অসুবিধার মধ্যেও অসংখ্য জোক আর মেমে ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাড়ার আড্ডায়! এ যেন অনেকটা স্কুল জীবনের নীরবতা পালনের মতো। ঠিক হচ্ছে না জেনেও, খুকখুক করে হাসির সংক্রমণ।

আর সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাসের পাশাপাশিই, শেয়ার বাজারের দর ওঠা-পড়ার মতো প্রায়ই বদলে যাচ্ছে বাতিল নোট পাল্টানোর সময়সীমা। কে জানে, বুকিরা এর ওপরেও গোপনে বাজি ধরছে কি না! অবশ্য অনেকে তো বলছেন বুকি-টুকিদের দিন শেষ। এর মধ্যেই আবার মানুষ দেখতে পেলেন, ভোটের মতো নোটের জন্যও কালি দিয়ে তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হল।আমার পরিচিত এক ডাক্তার দাদা সে দিন বললেন, ‘‘আরে বাবা, কালো টাকা নগদে আর কত থাকে! রাঘব বোয়ালরা সে সব বাড়িতে বসিয়ে পচায় না। এতে ‘ক্যাওস’ ছাড়া আর কিছুই হবে না। রাজনৈতিক যাত্রাপালা এ সব। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সে তিমিরেই থাকব।’’ হয়তো ঠিক।

তবু বলব, এই ঘটনার আর একটা দিকও আছে! আমাদের সামনে শোভন ও সৎ সেজে ঘুরে বেড়ানো বহু মানুষের মুখোশ খুলে পড়তে দেখলাম এই ক’দিনে। সাধারণের মধ্যে মিশে থাকা এই মানুষের পালে যেন সত্যিই বাঘ পড়েছে এ বার! অতিরিক্ত টাকার গরমে ধরাকে সরা জ্ঞান করা বেশ কিছু মানুষ যে ভাবতে শুরু করেছিলেন তাঁরা টাকার জোরে সব কিছুর ঊর্ধ্বে, সেই মনোভাবে কোথাও যেন ঘা পড়েছে। আসলে, মিডাস যা ধরছিল তা-ই সোনা হয়ে যাচ্ছিল বটে। কিন্তু বুঝতে পারেনি তা করতে গিয়ে নিজের সন্তানও আচমকা প্রাণহীন সোনার মূর্তি হয়ে যাবে!আসলে এ ধরনের পদক্ষেপকে এক কথায় ভাল বা খারাপ বলা মুশকিল! এখন তো টাকা বদল, জমা, তোলা— এ সবের ঢালাও প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু তা-ও গোটা দেশের নিরিখে যে পর্যাপ্ত নয়, তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি রাজায় রাজায় যুদ্ধও শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা যারা উলুখাগড়া, তারা এটুকুই বুঝেছি এই ‘ক্যাশ ক্রাঞ্চ’-এর সংকীর্ণ গলি লাইন দিয়েই পেরোতে হবে আমাদের। চাষাবাদ টালমাটাল হবে, বিয়ে-সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও চিকিৎসার মতো দরকারি বিষয়গুলো থমকে যাবে। বহু অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। তার পরেও মনের জোর আর সহ্য শক্তি— এ দু’টোই তো সাধারণ মানুষের চিরকালীন সম্বল!

এত বড় একটা দেশ আমাদের। বুক-পকেট, ব্যাক-পকেট, লুকনো-পকেটের মতো তার লক্ষ লক্ষ শহর, গঞ্জ, গ্রাম! সেখানকার অগণিত মানুষ অর্থনীতির সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ বোঝেন না। তাঁরা মোটের ওপর বেঁচে থাকার ন্যূনতম সাধনটি পেলেই খুশি। কিন্তু তাঁরাও কি তা পাচ্ছেন? দেশের ভালর জন্য তো আমরা সকলেই কষ্ট সহ্য করতে রাজি। কিন্তু সেটার সময় সীমা কি সত্যিই পঞ্চাশ দিন!

সেই ভারতে, যে ভারত এখনও ভাল করে বোঝে না প্লাস্টিক মানি। ভার্চুয়াল মানি বললে এখনও শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে যে ভারত। যে ভারত এখনও চাল-ডাল-গেঁহুর নগদ টাকার দেশ। সেই দেশে এই চড়া দ্রব্যমূল্যের বাজারে কত দিন সাধারণ মানুষ রেশন করে বেঁধে দেওয়া টাকায় নিজেদের সংযত রাখতে পারবেন? মাছওয়ালা দাদা কত দিন নেবেন বাতিল নোট? সেই ম্লানমুখের কিন্নরটিই বা কত দিন শূন্য হাত বাড়িয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াবেন ট্র্যাফিক সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়িগুলির জানলায় জানলায়?

এ দেশের আমজনতা এখন যেন মফস্সলের দুপুরে, অচল কুড়ি পয়সা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ন’বছরের বালকটি। এখন দেখার, সেই পানওয়ালা দাদু কী করেন!

Common people unaware demonetization
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy