Advertisement
২২ মে ২০২৪

তৃণমূল-অডিটরের সই নিয়েও সংশয়

ত্রিনেত্র-র পরে এ বার তৃণমূলের ব্যালান্স শিটেও অডিটরের সই নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল। রাজ্যের শাসক দলের তরফে আয়কর দফতর এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে যে সব অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। আনন্দবাজারের তরফে অডিটর প্রাণকুমার চক্রবর্তীর বাড়ি গিয়ে দেখা গিয়েছিল, তিনি অসুস্থ। এবং তাঁর পরিবারের লোকেরা দাবি করেছিলেন, গত চার বছর ধরে অডিটের কোনও কাজই করেননি প্রাণকুমারবাবু।

পুরভোটের প্রচারে সত্যনারায়ণ পার্কের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। ছবি: দেবাশিস রায়।

পুরভোটের প্রচারে সত্যনারায়ণ পার্কের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার। ছবি: দেবাশিস রায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

ত্রিনেত্র-র পরে এ বার তৃণমূলের ব্যালান্স শিটেও অডিটরের সই নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল।

রাজ্যের শাসক দলের তরফে আয়কর দফতর এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে যে সব অডিট রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। আনন্দবাজারের তরফে অডিটর প্রাণকুমার চক্রবর্তীর বাড়ি গিয়ে দেখা গিয়েছিল, তিনি অসুস্থ। এবং তাঁর পরিবারের লোকেরা দাবি করেছিলেন, গত চার বছর ধরে অডিটের কোনও কাজই করেননি প্রাণকুমারবাবু।

এই অবস্থায়, তৃণমূলের কাছ থেকে ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যাবতীয় আয়-ব্যয়ের হিসেব চেয়ে পাঠায় সিবিআই। যার মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি বিক্রি করে রোজগারের বিষয়টিও রয়েছে। বুধবার দলীয় জনসভায় সিবিআইয়ের দেওয়া নোটিস দিস্তা করে দিল্লি পাঠানোর হুঙ্কার দিলেও বৃহস্পতিবারই তৃণমূল বিধায়ক তাপস রায়কে দিয়ে জবাব পাঠিয়ে দিয়েছেন মমতা। এবং সেই নথি খতিয়ে দেখে প্রাথমিক ভাবে সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের বক্তব্য, অডিট রিপোর্টের এক-এক জায়গায় অডিটরের সই এক-এক রকম। সইগুলির যথার্থতা প্রমাণের জন্য ফরেন্সিক তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। সিবিআইয়ের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘ওই অডিটরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। প্রয়োজনে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাঁর সই নকল করা হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখবেন তদন্তকারীরা। তার পর আদালতগ্রাহ্য প্রমাণের জন্য তার ফরেন্সিক পরীক্ষা হবে।’’

কী ভাবে হবে এই ফরেন্সিক পরীক্ষা? সিবিআইয়ের ওই কর্তা জানান, ওই অডিটরের লেখার ধরন, একটা বর্ণ লেখার পর তিনি কতটা ফাঁক রাখেন, বেশি গতিতে লিখলে বর্ণের ধাঁচ কেমন দাঁড়ায়, তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হবে। প্রাণকুমারবাবু যদি সত্যিই অ্যালঝাইমার্সের রোগী হন, তবে সইয়ের মধ্যেও তার প্রতিফলন হবে। সুস্থ অবস্থায় তিনি যে সব অডিট রিপোর্টে সই করেছেন তার নমুনাও সংগ্রহ করবেন তদন্তকারীরা। সব খতিয়ে দেখে বিশেষজ্ঞরা এই রিপোর্ট তৈরি করবেন। আদালতে এই রিপোর্টের মান্যতা রয়েছে বলে সিবিআইয়ের দাবি।

তৃণমূলের দাখিল করা অডিট রিপোর্টে কোনও বিভ্রান্তি নেই বলেই অবশ্য এ দিন দাবি করেছেন মমতা। বৃহস্পতিবার সিবিআই-কে নথিপত্র জমা দেওয়ার সময় তৃণমূলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ওই সব নথি আসল কি না, তা তাদের জানা নেই। কিছু নথি দলের প্রাক্তন সবর্ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের কাছেও থাকতে পারে। অতএব নথিতে গরমিল থাকলে সিবিআই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করুক।

মুকুলের উপরে দায় চাপানোর এই কৌশল শুক্রবারও বজায় রেখেছিলেন মমতা। কলকাতার পুরভোট উপলক্ষে বড়বাজারের সত্যনারায়ণ পার্কে দলীয় সভায় মুকুলের নাম না-করে তিনি বলেন, ‘‘এক জনের উপর দায়িত্ব ছিল। তিনিই দেখতেন। এখন তিনি নেই। আমি তখন দেখতাম না। তিনিও আমাদের দেখাতেন না। দল তাঁকে বিশ্বাস করে এই দায়িত্ব দিয়েছিল। যদি কেউ অন্যায় করে থাকে, সেটা তাঁর দোষ।’’ কিন্তু এর পরেই মমতা জানান, এখন (মুকুল-অপসারণের পরে) দলীয় আয়-ব্যয় সংক্রান্ত হিসেব এবং যাবতীয় নথি তিনি নিজেই দেখভাল করছেন। নথি পরীক্ষা করে তিনি তেমন কোনও বিভ্রান্তি পাননি। সভার পরে ঘনিষ্ঠ মহলেও দলীয় হিসেবে কোনও রকম গরমিল নেই বলেই দাবি করেছেন তৃণমূল নেত্রী। দলনেত্রীর এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মুকুলের প্রতিক্রিয়া অবশ্য রাত পর্যন্ত জানা যায়নি।

তাঁর ছবি বিক্রির টাকার একটা হিসেবও এ দিন নিজের থেকেই দিয়েছেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘আড়াইশো-তিনশো ছবি এঁকেছি। এর মধ্যে একটাই ছবির দাম ২০ লক্ষ টাকার বেশি। আর দু’একটা ছবি ১ লক্ষ, ২ লক্ষ, ৩-৪ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে।’’ বেশির ভাগ ছবিই তিনি বিনা পয়সায় বিভিন্ন জনকে দিয়ে দিয়েছেন বলে মমতা দাবি করেন। সেই সব ছবি নিয়েই ‘জাগো বাংলা’ বিভিন্ন সময়ে প্রদর্শনী করেছে জানিয়ে মমতা বলেন, ‘‘দু’তিন বছরে প্রদর্শনী করে, ছবি বিক্রি করে ‘জাগো বাংলা’-র দু’কোটি টাকার কিছু বেশি আয় হয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকা মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে এবং ১০ লক্ষ রাজ্যপালের তহবিলে দেওয়া হয়েছে।’’ মমতার দাবি, ছবি বিক্রি বাবদ প্রাপ্ত টাকার সবটাই তিনি দলীয় মুখপত্র ‘জাগো বাংলা’র নামে হলফনামা করে দিয়ে দিয়েছিলেন। দলীয় তহবিলে সে টাকা যায়নি।

দলের খরচ চালানোর জন্য চাঁদা তোলা প্রসঙ্গে মমতা বলেন, ‘‘কেউ কেউ নিজের থেকে চাঁদা দেয় আমাদের। যে যা দেয়, সে ১ টাকা হোক বা হাজার টাকা, জনগণের টাকা নিতেই হয়। চাঁদাও তুলতে হয় আমাদের। কারও থেকে ধারও নিতে হয়।’’ এই চাঁদা-অনুদানের সবিস্তার তথ্য আয়কর দফতরে জমা দেওয়া হয়েছে বলে মমতা জানান।

আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে স্বচ্ছ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর দল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা করছে বলেই প্রধানমন্ত্রী সিবিআই-কে দিয়ে হেনস্থা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে এ দিন ফের অভিযোগ করেন তৃণমূল নেত্রী। ‘‘মোদীর বিরুদ্ধে তৃণমূল কথা বলে। জমি নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম বলে, তোমাদের মুখোশটা খুলে দিই বলে আমাদের নোটিস পাঠিয়েছ! লড়তে পারলে রাজনৈতিক ভাবে লড়ো। আমি পরোয়া করি না। কিছু মনেও করি না। যত ক্ষণ প্রাণ আছে, লড়ে নেব,’’ হুমকি দিয়েছেন তিনি। এবং এ দিনও প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘আয়কর দফতর, নির্বাচন কমিশনকে দলের হিসেব দেওয়া হয়েছে। সিবিআইয়ের তা চাওয়ার কী অধিকার রয়েছে?’’

কিন্তু সিবিআইয়ের নোটিসের জবাব না-দেওয়ার কথা ঘোষণা করার পর দিনই নথিপত্র পাঠালেন কেন? মমতার ব্যাখ্যা, কোনও বাধ্যবাধকতায় নয়, শুধুমাত্র ভদ্রতার খাতিরে সিবিআইয়ের পাঠানো নোটিসের জবাব দিয়েছেন তিনি।

দলীয় তহবিলের স্বচ্ছতা নিয়ে মমতার দাবির দিনেই ত্রিনেত্র, জগজ্জননী, মন্দাপম বিভিন্ন ‘ভুয়ো’ সংস্থার মাধ্যমে তৃণমূলের কাছে টাকা এসেছে বলে অভিযোগ তুললেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তাঁর অভিযোগ, ‘‘যখন সব ব্যাপারে সততার কথা বলা হয়, তখন টাকার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা থাকার প্রয়োজন। কিন্তু তা নেই। তৃণমূলের তহবিলের যে কোটি কোটি টাকা জমা পড়েছে, তা বিদেশ থেকে এসেছে, নাকি কালো টাকা তা জানা দরকার।’’ ত্রিনেত্র, জগজ্জননী দু’টি সংস্থারই অ্যাকাউন্ট নম্বর এক তা জানিয়ে বিমানবাবু বলেন, ‘‘শুধু তৃণমূলের তহবিলে ফুলে ফেঁপে উঠেছে তা নয়, নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, কলকাতার মেয়রের সম্পত্তি পাঁচ বছরে ৬২ লক্ষ থেকে বে়ড়ে ১ কোটি ৫১ লক্ষ হয়েছে!’’

তৃণমূলের সম্পত্তি নিয়ে কিছু প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে বলে মনে করছেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরাও। তাঁদের বক্তব্য, অডিট রিপোর্টে দলের স্থায়ী সম্পত্তির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৩৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। এর মধ্যে মাত্র তিনটি জিনিস রয়েছে। এক, জমির দাম (২২ লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা), দুই, কম্পিউটার অ্যাকাউন্ট (২৪ হাজার টাকা) এবং তিন, মোটর গাড়ি (১১ লক্ষ ১৯ হাজার টাকা)। এ ছাড়া দলের আর কোনও স্থায়ী সম্পত্তি নেই। সিবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, অন্য রাজনৈতিক দল তাঁদের আসবাবপত্র, বাড়ি ইত্যাদি সম্পত্তির হিসাবে দেখিয়েছে। কিন্তু তৃণমূলের খাতায় সে সব নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE