প্রথমে কেতুগ্রামে দ্বাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীর গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু। তার পরেই সবংয়ে ছাত্র পরিষদের এক সমর্থককে পিটিয়ে হত্যা। এই জোড়া ঘটনার প্রতিবাদে আগামী ২০ অগস্ট ১২ ঘণ্টার বাংলা বন্ধ ডাকল প্রদেশ কংগ্রেস। তৃণমূলকে কোণঠাসা করতে সেই বন্ধে নৈতিক সমর্থন দেওয়ার দাবি উঠল বাম শিবিরেও।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বাংলা বন্ধের ঘোষণা করে রবিবার বলেছেন, ‘‘যা পরিস্থিতি, তাতে চুপ করে বসে থাকার সময় নেই! কামদুনি থেকে কেতুগ্রাম, তৃণমূল জমানায় খুন-ধর্ষণ অবিরত চলছে।
পুলিশি শাসন নেই। মানুষের কাছে হাতজোড় করে আবেদন করছি, এর প্রতিবাদে তাঁরা বন্ধে সামিল হোন।’’
সবংয়ের সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যেই আক্রমণের শিকার হয়ে কৃষ্ণপ্রসাদ জানা নামে ছাত্রের মৃত্যুর পরেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, এর পরে আর বসে থাকা চলে না! সকলে মিলে প্রতিবাদ না হলে আক্রমণ আরও বাড়বে। যে হেতু সংবয়ের ঘটনায় অভিযোগের তির তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দিকে, সূর্যবাবুর ওই আহ্বানের পরেই পথে নেমে প্রতিবাদ শুরু করেছিল বামেদের নানা সংগঠন। কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদের সমর্থকের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল করতে গিয়ে তৃণমূলের হাতে এসএফআইকে আক্রান্তও হতে হয়েছে বলে অভিযোগ। এই পরিস্থিতিতেই কংগ্রেসের ডাকা বন্ধকে নৈতিক সমর্থন করার পক্ষে সওয়াল করছেন বাম শিবিরের একাধিক নেতা।
কংগ্রেসের বন্ধ নিয়ে তাদের অবস্থান অবশ্য সঙ্গত কারণেই পত্রপাঠ স্পষ্ট করতে পারেনি বামেরা। সূর্যবাবু এ দিন বলেছেন, ‘‘এখনও সময় আছে। এই ব্যাপারে বামফ্রন্ট দু-এক দিনের মধ্যেই আলোচনায় বসবে।’’ তবে সিপিএমেরই কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘এমন প্রশ্নে এই বন্ধ ডাকা হয়েছে, যার বিরোধিতা করার কারণ নেই। কিন্তু নৈতিক সমর্থন দেওয়া হবে কি না, বামফ্রন্টের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।’’ বস্তুত, নিচু তলায় শাসক দল তৃণমূলকে একঘরে করে ফেলার যে লক্ষ্য নিয়ে এখন সিপিএম এগোচ্ছে, সবং-কাণ্ড তাদের হাতে-গরম সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। তৃণমূল জমানায় অরাজকতার বিরুদ্ধে নিজেদের মতো করে পথে নেমে পড়েছে এসএফআই থেকে এবিভিপি, ছাত্র পরিষদ থেকে এসইউসি-র (কংগ্রেসের নামেই যাদের আপত্তি থাকে) ডিএসও পর্যন্ত নানা সংগঠন। ধর্মতলায় ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিন বিরোধী বাম, কংগ্রেস ও বিজেপি-কে আক্রমণ করে যে ‘হ-য-ব-র-ল’ তত্ত্ব দিয়েছিলেন, বাস্তবে গত দু’দিনে তারই প্রতিফলন ঘটিয়ে দিয়েছে সবং-কাণ্ড!
এর মধ্যেই আবার শাসক তৃণমূলের সঙ্গে একই সুরে কংগ্রেসের বন্ধের বিরোধিতা করেছে বিরোধী বিজেপি। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, ‘‘যে কংগ্রেস রাজীব গাঁধীর মৃত্যুদিন মনে রাখতে পারে না, তাদের নিয়ে আর মন্তব্য করার কী আছে! বাংলার বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য যখন ত্রাণ চলছে, সেই সময়ে নিজেদের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বন্ধ ডেকে মানুষের দুর্ভোগ বাড়াতে চাইছেন কংগ্রেস নেতারা।’’ একই সঙ্গে পার্থবাবুর কটাক্ষ, ‘‘তবে যাঁরা বন্ধ করছেন, তাঁরাও জানেন তাঁদের ডাকে একটা পাড়াও বন্ধ হবে না! বাংলা তো দূরের কথা!’’ বন্যা ত্রাণে অসুবিধার যুক্তিতেই কংগ্রেসের কর্মসূচির বিরোধিতা করছে বিজেপি। দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের কথায়, ‘‘বাংলায় আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই, এ কথা ঠিক। প্রশাসন শাসক দলের তাঁবেদারি করছে, এটাও ঠিক। কিন্তু বন্যারত্রাণের জন্য আমরা এখন সব ধরনের দলীয় কর্মসূচি বন্ধ রেখেছি। এটা বন্ধ ডেকে মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করার উপযুক্ত সময় নয়।’’ বন্ধ-বিরোধিতায় তৃণমূল ও বিজেপি এ ভাবে এক বিন্দুতে এসে দাঁড়ানোয় বাম শিবিরের একাংশ মনে করছেন, কংগ্রেসকে নৈতিক সমর্থন দেওয়া উচিত। তাতে বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূলকে বিজেপি-র সঙ্গে এক বন্ধনীতে ফেলে দেখাতে সুবিধা হবে।
অধীর এ দিন বন্ধের ঘোষণা করেছেন শিলিগুড়ির হাসমিচকে দলীয় কার্যালয়ে বসে। সবংয়ে ছাত্র পরিষদের এক সমর্থক খুন হওয়ার পরে সিপিএম যেখানে পথে নেমে পড়ল, নিহতের বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে গেলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি, অথচ প্রদেশ সভাপতি কেন এক বার ঘটনাস্থলে গিয়ে দাঁড়ালেন না— এই প্রশ্ন উঠেছে কংগ্রেসেই। এই নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে বুঝেই কড়া বিবৃতি-সহ বন্ধ ডেকে প্রদেশ সভাপতি মুখরক্ষার চেষ্টা করেছেন বলে দলের একাংশের ব্যাখ্যা। অধীর বলেছেন, ‘‘হিম্মত থাকলে সিবিআই তদন্ত হোক! তাতে ছাত্র পরিষদের কেউ দোষী হলে তাদেরও সাজা হবে।’’ কিন্তু বন্ধেও ‘সদ্ভাবনা দিবস’ এসে গিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে!
সবংয়ের কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেছেন, ‘‘প্রদেশ সভাপতির সঙ্গে কথা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বন্ধই উপযুক্ত প্রতিবাদ। কিন্তু ২০ অগস্ট রাজীব গাঁধীর জন্মদিন এক রকম ভাবে পালন করা হয়। তাই সভাপতিকে অনুরোধ করেছি, বন্ধ এক দিন পিছিয়ে ২১ তারিখ করলে ভাল হয়।’’ প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন, ‘‘ছাত্র ও যুব ছিল রাজীব গাঁধীর অত্যন্ত প্রিয় সংগঠন। জন্মদিনে তাঁর ছবিতে শুধু ফুল না দিয়ে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদ করলে অসুবিধা কোথায়?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy